banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 703 বার পঠিত

 

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৬

তাহনিয়া খান


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]

আমাদের বাস চলা শুরু করলো মক্কার দিকে। পথ আর শেষ হয় না। মরুভূমির মাঝখান দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা। হঠাত করে একটা দুটো বাড়ি চোখে পরে। মাঝে মাঝে উট দেখা যায়। পথেই মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়াতে বাসেই নামাজ পড়ে ফেললাম। আমার ভাই নামাজ পড়ে লম্বা এক ঘুম দিল। আমি চলন্ত বাসে বা ট্রেনে ঘুমাতে পারিনা। অন্ধকার ঘন হয়ে আসাতে দূরে তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছিল না। শুধু মক্কার ভিতরে ঢোকার সময় রাস্তায় যে বড় করে রেহালে কোরআন শরীফ রাখার আকৃতি করে গেইট বানানো হয়েছিল সেটা দেখতে পেলাম। ভাইকে ডেকে বললাম মক্কায় ঢুকে গিয়েছি।

মক্কায় ঢুকেও নিয়মের শেষ নেই। কতবার যে বাস থামলো আর আমাদের মাথা গুনলো আর খাবার দিল, হিসাব নেই। খাবারের বাক্সের মাঝে থাকতো বিস্কিট, খেজুর, মধু আর কেক। প্রথমে একবার দু’বার এই খাবার খিদার সময় ভালোই লাগতো। কিন্তু পরবর্তিতে এই খাবারের বক্স এত পেয়েছি যে কেউ সেধে দিলেও নিতাম না।

মক্কায় যখন আমাদের হোটেলের সামনে এনে রাখা হলো, তখনই হারাম শরীফরে থেকে এশার আজান শুনতে পেলাম। মন তো আর মানে না, মনে হচ্ছিল সব ফেলে ছুটে চলে যাই মসজিদে। কিন্তু উপায় নেই। কিছু ফর্মালিটিস শেষ করে আমাদের মোয়াল্লেম সবাইকে বিশ্রাম নিতে বললেন এবং পরেরদিন সকালের জন্য প্রস্তুত থাকতে বললেন। সকালে তিনি আমাদের উমরাহ্‌ করতে নিয়ে যাবেন। তারপর আমরা নিজেদের ইচ্ছামত চলাফেরা করতে পারবো।

পরের দিন ছিল শুক্রবার। অদ্ভুত এক ঘটনা হয়েছিল আমাদের। মক্কায় প্রথম নামাজ পড়লাম জুম্মার নামাজ। মদিনায় প্রথম ও শেষ নামাজ পড়েছিলাম জুম্মার নামাজ। আমরা হোটেলে এসেই এশার নামাজ পড়ে শুয়ে গেলাম। ঘুম কি আর আসে। ফজরের নামাজ পড়েই সবাই হোটেলের নীচে চলে আসলাম। আমাদের মোয়াল্লেম আমাদের কে একটা করে কমলা রঙের কাপড়ের টুকরো দিলেন, যেখানে এজেন্সির নাম বড় করে লেখা ছিল। যাতে সবাই এক সাথে থাকতে পারি আর হারিয়ে না যাই দল থেকে, সেজন্য এই ব্যবস্থা।

হোটেল থেকে বের হয়েই ইবরাহীম খলিল রোড। একটু হাঁটলেই হারাম শরিফের দুটো মিনার দেখা যায়। হোটেল থেকে হারাম শরীফ যেতে ৫-৬ মিনিট লাগতো। একটু আগালেই দেখলাম কবুতর চত্বর। মক্কা মদিনায় এত কবুতর দেখেছি, তারা মানুষকে এক ফোঁটাও বিরক্ত করতো না, এমনকি কোথাও বাথরুমও করতো না। আশ্চর্য লেগেছে ব্যাপারটা। নামাজের সময় যখন মানুষজন নামাজ পড়তো , তখন কোথায় যেন এসব কবুতর চলে যেত।

যাই হোক, কবুতর চত্বর পার হতেই উত্তেজনায় বুক কাঁপছিল। আমার ভাই তার ডান হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলছিল, আপু, আল্লাহ্‌ নিয়ে আসছে আমাদের, আল্লাহ্‌ নিয়ে আসছে। সে যতবার এই কথা বলছিল , ততবার আমি আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলছিলাম। ভাবছিলাম, দুনিয়াতে তো কত লোক আছে, সবার মাঝখান থেকে আল্লাহ্‌ আমাদের এখানে উনার মেহমান করে নিয়ে এসেছেন। এত সম্মান তিনি আমাদের দিয়েছেন। সারা জীবন সেজদায় পড়ে থাকলেও তো এর শুকরিয়া আদায় হবে না।

মসজিদের ভিতর ঢুকলাম। দূর থেকেই একটা পিলারের আড়াল থেকে কালো ঘরটা দেখা যাচ্ছে। আমি লিখে প্রকাশ করতে পারবোনা আমার মনের অবস্থা। অনেক কিছু প্ল্যান করে রেখেছিলাম যে আমি এই দোয়া করবো, সেই দোয়া করবো। আমি সব ভুলে গেলাম। শুধু বলে যেতে লাগলাম আল্লাহ্‌ আমার গুনাহ মাফ কর, প্লিজ মাফ কর। যতক্ষন পর্যন্ত না মন স্থির না হলো, আমি এই একই দোয়া পড়েই যাচ্ছিলাম। মন স্থির হওয়ার পর অন্য দোয়া করেছিলাম। দোয়া শেষে পিছনে ফিরে দেখলাম আমার ভাই তখনো দোয়া করছে। আর আমার দলের লোকেরা নেই। একটু এগিয়ে দেখি তারা সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এর মাঝে আমার ভাই চলে আসলো।

যে কালো ঘরটা প্রায়ই টেলিভিশনে দেখতাম, সেটা এখন চোখের সামনে। এত সুন্দর ! এত বড় ! তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। আমি সারা জীবন এই ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমার চোখ কখনোই ক্লান্ত হবে না, কোন দিন না।

হজ্জের ষষ্ঠ শিক্ষা- আম্মু বলেছিল, আমরা যেই দোয়াই করি না কেন সেটা কবুল হবে। যা চাই আল্লাহ্‌ সেটাই দিবেন। যখন প্রয়োজন তখন দিবেন। যে জিনিস চাই সেটা যদি আমার দরকার না লাগে, তাহলে যেটা আমার দরকার সেটাই দিবেন। আর এই দুনিয়াতে যদি কিছু না পাই তাহলে পরকালে এই দোয়ার বিনিময় পাবো। মানে দোয়া কবুল হবেই হবে। আমার আব্বু আম্মু সবসময় দোয়া করেছেন যেন আমরা তিন ভাই বোন হজ্জ করতে পারি। আমি নিজেও দোয়া করেছি। আল্লাহ্‌র স্পেশাল রহমতে দোয়া তো কবুল হয়ে গিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে আমি যে বয়সে হজ্জ করতে গিয়েছি সেটা আমার জন্য একদম সঠিক সময়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে আমি ছিলাম পরিপুর্ন। আল্লাহ্‌র কাছে চেয়েছিলাম কাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আল্লাহ্‌ আমাকে সেই ঘরের সামনে নিয়ে দাড়া করিয়েছেন। এত বড় স্বপ্ন পূরণের পর আমার হদয়ে ও মস্তিষ্কে গেঁথে গেল দোয়া কখনোই ব্যার্থ হয় না। কখনোই না।

পর্ব-৫

Facebook Comments