banner

রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 29 বার পঠিত

 

রিমান্ডের নামে ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা

 

ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার অপরাধ কী ছিল? তিনি হেফাজত নেতাদের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের জামিনের জন্য লড়েছিলেন। কিন্তু এই আইনসঙ্গত কাজই তার জীবনে এক ভয়াবহ বিভীষিকা নিয়ে আসে। তাকে জঙ্গি বানিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়, চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়, রিমান্ডে নিয়ে চলতে থাকে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন।

২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট। রাতের অন্ধকারে ধানমন্ডিতে শাকিলা ফারজানার বাসায় প্রায় ২০০ জন র‍্যাব সদস্য হানা দেয়। কোনো প্রশ্ন, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই তাকে জানানো হয়—”আপনাকে জঙ্গি অর্থায়নের মামলায় গ্রেপ্তার করা হলো।” এই ঘোষণার পরপরই তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়, তুলে নেওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে।
তিনি তখনো বুঝতে পারছিলেন না, আসলে কী ঘটছে। কিছুক্ষণ পর তাকে একটি ছোট ঘরে ঢোকানো হয়। সেই ঘর থেকে ভেসে আসছিল বিদ্যুতের শকের শব্দ। তীব্র সেই শব্দে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
এরপর শুরু হয় ভয়াবহ মারধর। কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তোর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড দে!” আতঙ্কিত শাকিলা তখন কিছুই মনে করতে পারছিলেন না। কিন্তু তারা থামেনি। অকথ্য গালাগালির সঙ্গে চলতে থাকে চড়, থাপ্পড়, লাথি। পাশে থেকে ভেসে আসছিল তার সহকারী আইনজীবী লিটনের চিৎকার। তাকেও ধরে এনেছিল তারা।

অমানবিক নির্যাতনের পর তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। গাড়ি চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিছু সময় পর ওয়্যারলেসে এক কর্মকর্তা বলেন, “স্যার, আমরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সামনে। অপারেশনে যাব?”
এই কথা শুনেই শাকিলার মনে হয়েছিল, এবার বোধহয় সব শেষ। তাকে গুলি করে হত্যা করে ‘জঙ্গি’ হিসেবে চালিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করে, গন্তব্য পতেঙ্গায় র‍্যাব-৭ সদর দফতর।
সেখানে পৌঁছানোর পর তার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। এরপর তাকে বলা হয়, “সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছে। আমরা যা বলব, তাই বলবেন।” অর্থাৎ, পুরো ঘটনাটি মিডিয়ার সামনে সাজানো হবে।

শাকিলাকে প্রথমে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তারপর আরও দুদিন রিমান্ডে রেখে চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। রিমান্ডের প্রথম দিনই তার ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার। একজন কর্মকর্তা, যিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার মুখের সামনে এসে মদের গন্ধ ছাড়ছিলেন, সঙ্গে চলছিল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি ও লাথি।
তিনি পরে জানতে পারেন, এই কর্মকর্তা আর কেউ নন, সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
এমনকি তাকে ভয় দেখানো হয়, “তোমার বড় ছেলেকে ধরে এনে জঙ্গি বানিয়ে দেব।” সেই মুহূর্তে শাকিলা কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে বলেন, “ওর দিকে হাত না বাড়িয়ে আমাকে মেরে ফেলুন।”

কারাগারে পাঠানোর পরও তার নির্যাতন থামেনি। সেখানে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করার জন্য প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লোহার গারদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।
একদিন তিনি দেখেন, জেলগেটের বাইরে তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। পরে জানতে পারেন তার মা প্রতিদিন জেলগেটে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন, মেয়েকে একবার দেখার আশায়।
কারাগারে মাঝেমধ্যে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখতেন, তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এক নারী অবয়বের কেউ সামনে ব্লেড নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, যেন যে কোনো মুহূর্তে আঘাত করবে। ভয়ে শাকিলা চিৎকার করে উঠতেন।

মুক্তি পেলেও স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে
প্রায় ১০ মাস বন্দি থাকার পর ২০১৬ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাকে জামিন দেয়। তিনি মুক্তি পান, কিন্তু তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান সময়, হারিয়ে যায় স্বাভাবিকতা।
শাকিলা ফারজানার বাবা এই মানসিক ধাক্কা সহ্য করতে পারেননি। মেয়ের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার কষ্টে তিনি স্ট্রোক করে মারা যান।
আজও শাকিলা ফারজানা সেই বিভীষিকাময় রাতগুলোর কথা মনে করলে শিউরে ওঠেন। তিনি শুধু একজন আইনজীবী ছিলেন, যিনি বিচার বিভাগের নিয়ম মেনে জামিন করিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে ‘জঙ্গি’ বানিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকারে পরিণত করে।

এই নির্মমতার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে তো? নাকি ঘটে যাওয়া এই অন্যায় বিচারহীনতাই থেকে যাবে আমাদের সমাজের চিরস্থায়ী বাস্তবতা হিসেবে?

Facebook Comments