আবদুর রাজ্জাক ঘিওর, মানিকগঞ্জ: আমার ১২ বছরের ছেলে নাইম বায়না ধরছে। মা এরকম সুন্দর একটা পাঞ্জাবি আমারে দিতে হবে। কিন্তু কেমনে বুঝাবো ছেলেরে, এগুলো অনেক দামি, এগুলো আমাগো মতো মানুষের জন্য না। কথাগুলো বলতে বলতে ছালমা আক্তার অশ্র“ সংবরণ করতে পারলেন না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। বাড়ইল গ্রামের ছালমা আক্তার অনেকটা আবেগের সুরে জানালেন তার জীবনের করুণ কাহিনী। তিন বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর সেলাইয়ের কাজ করে এক ছেলেকে নিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। বাড়িতে এনে পাঞ্জাবির নকশার কাজ করেন। আর সেই টাকায় চলে সংসার।
রোজার এ শেষ সময় ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার নারী থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়ায় নকশা তোলার কাজে ব্যস্ত। ঈদ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তে তাদের এই ব্যস্ততা। এখানকার নকশাতোলা পাঞ্জাবি, ফতুয়া বিক্রি হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। রফতানি হয় কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে।
যাদের শ্রম ও ঘামে আর স্বপ্নের মাধুরী মিশ্রিত সুনিপুণ হাতের সেলাই ও নকশা করা ড্রেসে দেশের অভিজাত মানুষের মন বর্ণিল হয়ে ওঠে, তাদের কথা আমরা কি কেউ ভাবি? তারা যে কতটা দৈন্যদশার আবর্তে জীবনযাপন করছেন তা নিজ চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
রাথুরা গ্রামের অজিফা বেগম বলেন, ‘আমাদের হাতে সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবি তৈরি হয়, সেগুলো অনেক দাম দিয়ে দামীদামি মানুষেরা পরেন; কিন্তু আমরা খালি চাইয়াই থাকি, পরনের ভাগ্য হয় না।’ তার সাথে আলাপকালে জানা যায়, একটি পাঞ্জাবিতে সুইসুতার নকশা করে তারা পান ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। একটি পাঞ্জাবির কাজ শেষ করতে তাদের তিন-চার দিন লাগে। তিনি বলেন, ‘এই অল্প আয় দিয়ে কি আর দামি কাপড় চোপড় কিনা যায়। অসুস্থ স্বামীর জন্য একটি লুঙ্গি আর ছেলে মেয়ের জন্য ফুটপাথ থেকে জামা কাপড় কিনছি।’
এবার ঈদে নিজের জন্য কী কিনবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জাবরা গ্রামের বিধবা শরীফা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দিন রাইত খাইটা যা পাই তা দিয়া সংসারই চলে না। তার পরও কিছু টেকা (টাকা) ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চাইয়া জমাইছি। মানিকগঞ্জ হকার্স মার্কেট থেইকা কিছু নতুন জামাকাপড় কিনা দিমু। দুঃখ অয় আমাগো হাতের কাজের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রিপিস শুনি অনেক দামি আর বিদেশ যায়, আর আমরাই ঈদ করি জাকাতের কাপড় দিয়া।’
প্রায় এক যুগ আগে মানিকগঞ্জে শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবির গায়ে সুইসুতা দিয়ে নকশা তোলার কাজ। প্রথম দিকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখতেন নারীদের এ কাজকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। গত এক দশকে এ নকশার কাজে নীরব বিপ্লব ঘটেছে মানিকগঞ্জ জেলায়। এখন প্রায় ৩০ হাজার নারী যুক্ত আছেন এ কাজে।
ব্র্যাকের ম্যানেজার শ্যামল কুমার দাশ জানান, প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে এ জেলায় সর্বপ্রথম বেকার ও দুস্থ নারীদের পোশাকের ভরাট কাজের ওপর প্রশিণ দেয়া হয়। আয়শা আবেদ সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার নারীকে প্রশিণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এ সেন্টারের আওতায় পাঁচ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের কারো কারো মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি আরো বলেন, এ বছর ঈদকে সামনে রেখে শুধু ব্্র্যাকই দেড় লাখ পিসের ওপরে পণ্য সরবরাহ করবে।
ুদ্র ও কুটির শিল্পে দেশের একমাত্র সিআইপি জননী ক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশনের মালিক রফিকুল ইসলাম পরান জানান, তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘরে বসে সারা বছর কাজ করেন প্রায় চার হাজার নারী।
নকশীর অন্যতম কর্ণধার রফিকুল ইসলাম বিশ্বাস মাসুদ জানান, তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার মহিলা পাঞ্জাবি-ফতুয়ায় ভরাট কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। ইউসুফ-ইব্রাহিম হ্যান্ডিক্র্যাফটের পরিচালক মো: ইউসুফ জানান, তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক হাজার শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন। বর্ণালী প্রিন্টার্সের মালিক মো: ইছহাক জানান, তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এ বছর ঈদ সামনে রেখে প্রায় ৫০ হাজার পিস পণ্য বাজারজাত করা হবে।
কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে আবার কয়েকজন মিলে ুদ্র ুদ্র সঞ্চয় এক করে শুরু করেছেন এই হ্যান্ডিক্র্যাফটের ব্যবসা। জেলার সদর উপজেলার সবক’টি ইউনিয়নে, শিবালয়, ঘিওর, সাটুরিয়া, হরিরামপুর, সিংগাইর ও দৌলতপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চলছে এই ভরাটের কাজ। কোথাও টিনের শেড তুলে আবার কোথাও নিজ ঘরে বসেই চলছে সুইসুতার এই নান্দনিক কাজ। অনেকেই সারা বছর এ কাজ না করলেও ঈদ সামনে রেখে লেগে যান সুইসুতা হাতে। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূসহ অনেকেই হয়ে যান মওসুমি কারিগর। এ সময়টি অনেকটা উৎসবে রূপ নেয় এই অঞ্চলে।
ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন এসব নারী। একটি পাঞ্জাবিতে সুইসুতার নকশা করে তারা পান ৯০-১৫০ টাকা। একটি পাঞ্জাবির কাজ শেষ করতে তাদের চার-পাঁচ দিন লাগে। প্রতিদিন গড়ে ছয়-সাত ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সে হিসেবে তাদের মজুরি খুবই কম।
এ ব্যাপারে মির্জাপুর রাজবংশী পাড়ার স্বামী পরিত্যক্তা সন্ধ্যা রানী রাজবংশী বলেন, ‘তিনটি পাঞ্জাবিতে নকশার কাজ করতে গিয়ে ডিজাইন ভুল হয়েছিল। এর জন্য আমারে কোনো মজুরি দেয় নাই। হিন্দু অইলেও প্রত্যেক ঈদে নতুন কাপড় কিনে মুসলমান বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াইতে যাই, কিন্তু এবার আর তা অইলো না।’ ঘিওর উপজেলার সাইংজুরী গ্রামের মুক্তা আক্তার, নারগিছ বেগম, নাছিমা, সীমা আক্তার জানান, ‘পেটের ভাতই জুটে না আবার দামি কাপড়চোপড় কিনব কেমনে।’
ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, হাতের কাজের নকশা করা পাঞ্জাবির ৭০ শতাংশই মানিকগঞ্জ থেকে সরবরাহ করা হয়। এ এলাকায় এ কাজ হওয়ায় অনেক নারীরই সামান্য হলেও আয় করতে পারছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন কি-না। তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা গেলে তারাও ভালোভাবে ঈদ করতে পারত। বঞ্চিত হতো না ঈদের আনন্দ থেকে।
অপরাজিতাবিডি ডটকম/আরএ/এ/২৪ জুলাই ২০১৪ই