মোরা জোনাকি হতে চাই……৫
আফরোজা হাসান
মাঝে মাঝে মুখে বলা হাজারো শব্দরাও যা করতে পারে না, মৃদুমন্দ স্পর্শ তারচেয়ে অনেক বেশি কাজ করে যায়। উদভ্রান্তের মত সামনে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখে যায়েদের এই কথাটিই মনেহলো, এখন ওর কোন মৌখিক স্বান্তনার নয়, বরং আত্মিক অবলম্বন প্রয়োজন। ‘আমি আছি তোমার পাশে সর্বাবস্থায়’ অত্যাধিক শক্তিশালী একটি অ্যান্টিডোট হাল ছেড়ে দেয়া মানুষের জন্য। যার উপর ভর করে তারা বেড়িয়ে আসতে পারে গর্ত থেকে। সেই গর্ত যেটা কোন না কোন ভাবে তারা নিজেরাই খোঁড়ে নিজের জন্য। এই ছেলেটা যেমন জেনে বুঝে এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল যার চরিত্রে ছিল জাহিলিয়াতের ছায়া। ছেলেটির বিশ্বাস ছিল ভালোবাসা দিয়ে মেয়েটিকে বদলে দেবে। ভেতরে অট্টহাসি পাক দিয়ে উঠলো যায়েদের। নাটক-সিনেমা-গল্প-উপন্যাসই বর্তমান জেনারেশনের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনিটর করছে। ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করার বিভ্রান্তিকর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে এরা। যে স্বপ্নে এদেরকে টেনে নিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। তবে এটা ঠিক যে ভালোবাসা দিয়েই জয় করা সম্ভব জগতটাকে। তবে সেটা মানুষকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসা নয়। স্রষ্টাকে ঘিরে আবর্তিত ভালোবাসার দ্বারা।
আমি বাঁচতে চাইনা ডক্টর। প্লিজ আমাকে মরে যেতে দিন। বেঁচে থেকে কি লাভ আমার?
মরে গিয়ে কি লাভ তোমার? প্রশ্ন করলো যায়েদ।
প্রশ্নটা শুনে স্থির দৃষ্টিতে যায়েদের দিকে তাকালো সোহান।
যায়েদ সোহানের হাতে হাত রেখে খুব স্নেহ মাখা স্বরে বলল, হাল ছেড়ে দেবার জন্য, জীবনের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য, মৃত্যুকে বরণ করে নেবার জন্য অনেক কারণ হয়তো তোমার কাছে আছে। কিন্তু তুমি কি জানো ঘুরে দাঁড়াবার জন্য, জীবনকে উপভোগ করার জন্য, বেঁচে থাকাটাকে কাজে লাগানোর জন্য শুধু একটা কারণই যথেষ্ট? জানতে চাও সেই কারণটা কি?
হ্যা ডক্টর আমি জানতে চাই।
এটাই সেই কারণ। এই যে তুমি জানার ইচ্ছে পোষণ করলে। এই ইচ্ছেটাই সেই কারণ। যা কিছু তোমার জীবনে ঘটেছে এটাই শেষ নয়। আরো অনেক কিছু বাকি আছে তোমার জীবনে। সেসব কি জাস্ট সেটা জানার ইচ্ছেটা ধরে রাখতে হবে তোমাকে। ইচ্ছে কিভাবে ধরে রাখবে সেটার পেছনেও কারণ আছে।
কি কারণ?
হাত দিয়ে ঈশারায় কিছুটা দূরে দাড়িঁয়ে থাকা মাশরুফকে দেখিয়ে যায়েদ বলল, গতরাতে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর থেকে এক মূহুর্তের জন্যও স্থির হয়ে বসেনি মাশরুফ। ওর ডিউটি টাইম অনেক আগেই শেষ। তবুও বসে আছে শুধু তোমাকে ভালোবাসে, তোমার কেয়ার করে সেজন্য। তোমার বাবা সারারাত হসপিটালের ওয়েটিং হলে পায়চারী করে কাটিয়েছেন। তোমার মা জায়নামাজে বসে এখনো চোখের পানি ফেলছেন। তোমার ফ্যামেলির মানুষেরা একটু পর পর মাশরুফকে ফোন দিয়ে জানতে চাইছে এখন তোমার কি অবস্থা! আর যার জন্য তুমি জীবন দিতে যাচ্ছিলে সে অন্য কারো হাত ধরে সুখের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন তুমি ভেবে দেখো জীবনের কাছে তোমার প্রাপ্তি বেশি নাকি অপ্রাপ্তি? তোমার ভালোবাসার ভান্ডার ভারি নাকি শূন্যতার? তুমি এমন একজনের জন্য জীবন দিতে যাচ্ছিলে যার কাছে তোমার থাকা, না থাকা কোন স্পেশাল তো দূরে থাক নূন্যতম গুরুত্বও রাখে না। তাহলে তুমি সেই মানুষগুলোর জন্য কেন বেঁচে থাকতে পারবে না, তোমার চলে যাওয়া যাদের জীবনে অপূরণীয় শূন্যতার তৈরি করে যাবে?
দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো সোহানের। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি ডক্টর।
যায়েদ হেসে বলল, চারপাশের সবকিছু মিলিয়ে ভেবে দেখে না বলেই তো মানুষ এতটা অসহায় ফিল করে যে, নিজেই নিজেকে মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেয় নির্দ্বিধায়। সমস্যাটা কি জানো? আমার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু বেশির ভাগ সময়ই আমরা যা চাই, যা পছন্দ করি সেটার মধ্যে নিবদ্ধ থাকে। তাই সে জিনিসটা যখন আমরা না পাই তখন খুব অসহায় ফিল করি। মনেকরি বেঁচে থাকার জন্য আমার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ কেন্দ্রবিন্দু থেকে দৃষ্টিটাকে একটু খানি সরালেই জগতের আনন্দযজ্ঞের ভরপুর আয়োজনের দেখা মিলে। চলো আমার সাথে তোমাকে দেখাচ্ছি।
হাত বাড়িয়ে সোহানকে বেড থেকে নামতে সাহায্য করলো যায়েদ। এরপর ধরে ধরে নিয়ে এলো হসপিটালের লম্বা বারান্দায়। সামনেই হসপিটাল সংলগ্ন বিশাল পার্ক। হসপিটালের ইনফান্টিল সেকশনটাও ঐদিকেই। ফলে পার্ক জুড়ে ছড়ানো ছিটানো ছিল জীবন্ত, চলন্ত, ছুটন্ত নানা বয়সী, নানান রঙের ফুলে। হাত উঁচু করে ছোট্ট একটা শিশুকে দেখিয়ে যায়েদ হাসি মুখে বলল, দেখো ঐ বেবীটাকে। মেবি মাত্র এক পা দু পা করে চলতে শিখেছে। হাঁটতে গিয়ে যাতে পড়ে না যায়, ভারসাম্য যাতে ঠিক থাকে সেজন্য দু’হাত কিভাবে দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়েছো দেখেছো? ওকে কিন্তু এটা কেউ শেখায়নি। নিজেকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেই এটা উদ্ভাবন করে নিয়েছে। ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয়ার, নিজেকে বোঝানোর, নিজেকে আনন্দ দেবার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু যত আমরা বড় হতে থাকি নিজের ক্ষমতাগুলোকে অবমূল্যায়ন করতে থাকি। অন্যের উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে আমাদের। একটা সময় আমাদের অবস্থা এতই নাজুক হয়ে দাঁড়ায় যে অন্যেকে অবলম্বন না করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই অসম্ভব হয়ে যায় আমাদের জন্য। জন্মের সময় প্রতিটি মানব মনে এক টুকরো স্বর্ণলতা আর একটি বটবৃক্ষের চারা থাকে। আমাদের মন বটবৃক্ষ হবে নাকি স্বর্ণলতা এটা নির্ভর করে কোনটিকে বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ দেয়া হচ্ছে সেটার উপর। আফসোস হচ্ছে, বেশির ভাগ সময়ই আমাদের মন স্বর্ণলতা রূপে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পায়। তাই যেই বৃক্ষকে আঁকড়ে ধরে সেটা সরে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
সোহানের মনের অন্ধকার আবেগের ঘরে সূর্য কিরণ মতোই স্পর্শ রাখলো যায়েদের কথাগুলো। বেশ অনেকক্ষণ নীরবতার পর বলল, আমি বুঝতে শুরু করেছি ডক্টর। আসলে কোনদিন কেউ এমন করে ভাবতে শেখায়নি।
যায়েদ হেসে বলল, এখন তো শিখলে ভাবতে। আর কখনোই এমন বোকামী করবে না। মনে রাখবে তোমার জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই তোমার কাছে। জীবন নেই মানে তুমি নেই। আর তুমি নেই মানে জগত থাকা আর না থাকার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু তুমি থাকলে জগতের অস্তিত্ব যেমন থাকবে। ঠিক তেমনি নিয়ম মেনে বদলেও যাবে পরিবেশ-পরিস্থিতি সবকিছু। তাই সবসময় নিজের জন্য বাঁচতে চেষ্টা করবে। কারণ তোমার বেঁচে থাকাটাকে সৌন্দর্যময় করার জন্যই আসলে নানান উপকরণের প্রয়োজন। এখন উপকরণের যেই প্যাকেজ তুমি নিজের জন্য পছন্দ করেছো। সেই প্যাকেজ না পাওয়ার অর্থ এটা নয় যে, জীবনটাই বৃথা। খুব পছন্দের বীফ কারি না পেলে চিকেন কারি দিয়েও তো খাবারের চাহিদা মেটানো যায়। তাই না?
জ্বি ডক্টর।
সো টিনা চলে গিয়েছে যাক না। তুমি ইনা না মিনা কাউকে খুঁজে নিলেই তো হয়ে যাচ্ছে।
এই প্রথম হাসি ফুটে উঠলো সোহানের মুখে। বেশ শব্দ করেই হেসে ফেললো।
যায়েদও হেসে বলল, তোমার হাসি অনেক সুন্দর মাশাআল্লাহ। এই হাসিকে কারো মোহতাজ করো না। সময় লাগলে নিজেকে উজাড় করে সময় দাও। তারপর নতুন করে জীবনটাকে সাজিয়ে নাও। তবে এবার শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দেখে জীবনসাথী নির্ধারণ করো না। মানসিক সৌন্দর্য বিবর্জিত দৈহিক সৌন্দর্যটা অ্যাসিডের মতো ভয়ঙ্কর। যা অন্যের সাথে সাথে ব্যক্তির নিজ আত্মাকেও জ্বালিয়ে বিকৃত করে দেয়। তাই বিকৃত মন থেকে সদা সাবধান থাকবে। আর সবসময় মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করবে তোমার প্রতি ভালোবাসা পুর্ণ মনগুলোকে। তাকিয়ে দেখো তোমার পেছনে।
ঘুরে তাকিয়ে বাবাকে আসতে দেখে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো সোহান। তারপর সমস্ত দুর্বলতা ভুলে গিয়ে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। একে অন্যেকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিতা-পুত্রের সম্মিলিত অশ্রু দেখে জ্বালা করে উঠলো যায়েদের চোখও। আলতো করে চোখের ভেজা কোন মুছে নিয়ে মূহুর্তেই সামলে নিলো নিজেকে। পেশেন্টদের আনন্দ-বেদনা সবসময়ই সিক্ত করে দেয় তার মনকে।
নিজের কেবিনে ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে গেলো যায়েদ। দেখতে পেলো করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে দাড়িয়ে মুখে হাসি কিন্তু চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে সোহান আর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে। অদ্ভুত এক মায়ালোয় ছোঁয়া অভিব্যক্তি খেলা করছিল মেয়েটির চেহারা জুড়ে। কয়েকটি মূহুর্তের জন্য নিজের দৃষ্টিকে সংযত করার কথা ভুলে গেলো যায়েদ। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল হাসি-কান্নার সংমিশ্রণে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। কিন্তু যায়েদের দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে সামলে নিলো মেয়েটি। চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু মুছে নিতে নিতে ঝট করে পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো যায়েদের দিকে।
একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো যায়েদকে। আর এক মূহুর্তও না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো কেবিনের দিকে। এই রকম একটা আচরণ কেমন করে ঘটলো তার দ্বারা? ভাবতেই তিক্ত অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো মনকে। মেয়েটি কি ভাবছে তার সম্পর্কে? নিশ্চয়ই খুব নেতিবাচক কিছুই ভাবছে? পরমূহুর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিলো যায়েদ। নিজেই নিজেকে বলল, মেয়েটির কথা ভেবে একই ভুল তুমি পুনঃপুনঃ করছো। শয়তানকে সুযোগ করে দিচ্ছো অসচেতনার ভুলের ক্ষনটিকে সচেতন পদস্ফলনে রূপান্তরিত করার। কোন জিনিসের কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়ে সেটার প্রতি মনকে দুর্বল করে পাপের পথে মানুষকে পরিচালিত করা শয়তানের একটি কৌশল। পেশেন্টদেরকে প্রায়ই এই কথাটা বলে যায়েদ। আজ নিজেই সেই পথে চলতে যাচ্ছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে আল্লাহর ক্ষমা এবং সঠিক পথে অবিচল রাখার হেদায়াত প্রার্থনা করতে করতে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে ছুটলো।
চলবে—
পর্ব-৬