banner

শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 164 বার পঠিত

 

মুসলিম ও অমুসলিম চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (আলাইহাস সালাম)

সুনানে ইবনে দাউদ:

আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে তিয়ালসী তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন:

আলী ইবনে আবি তালিব বলেছেন: তোমরা কি চাও না যে, নিজের ও নবী কন্যা ফাতেমা সম্পর্কে তোমাদেরকে অবগত করি?

তিনি মহানবী (স.) এর সবচেয়ে নিকটতম হওয়া সত্ত্বেও আমার বাড়ীতে যাতা পিষতে পিষতে তার হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হত, পানি বহনের কারণে তার কাঁধে ব্যথা হত,ঝাড়ু দান ও গৃহ পরিচ্ছন্ন করার কারণে তার পোষাক পুরোনো হয়ে যেত। শুনেছি যে, মহানবী (স.) এর নিকট কয়েকজন গৃহ পরিচারিকা ছিলেন (দাসী)। ফাতেমা সাহায্য গ্রহণের আশায় বাবার কাছে গেলেন। যাতে ঐ গৃহ পরিচারিকাদের একজনকে বাড়ীর কাজের জন্য তাঁর (স.) নিকট চাইতে পারেন। কিন্তু তিনি বাবার নিকট উপস্থিত হয়ে সেথায় উপস্থিত যুবকদেরকে দেখে অতিমাত্রায় লজ্জিত হয়ে নিজের আবেদন প্রকাশ করা হতে বিরত থাকলেন এবং মনের কথা না বলেই তিনি ফিরে আসলেন।

(সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৪)

সহীহ আল বুখারী:

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী নিজের প্রসিদ্ধ বুখারী গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ১৭তম পৃষ্ঠায় বাবু ফাদ্বায়েলুস সাহাবা’তে (১৩৭৬ ফার্সী/ ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে মক্কায় প্রকাশিত) নিজস্ব সনদে বর্ণনা করেছে যে, মহানবী (স.) বলেছেন:

‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ। যারা তাকে রাগান্বিত করবে (প্রকৃতপক্ষে) তারা আমাকে রাগান্বিত করেছে’।

৩য় খণ্ডের ১৪৬ পৃষ্ঠায় ও ৪র্থ খণ্ডের ২০৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.) বলেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যে তাকে রাগান্বিত করবে (প্রকৃত অর্থে) সে আমাকে রাগান্বিত করেছে।

৫ম খণ্ডের ২০তম পৃষ্ঠায় বলেছেন: ‘ফাতেমা বেহেশতের নারীদের সর্দার’।

সহীহ তিরমিযী:

প্রসিদ্ধ সহীহ তিরমিযী গ্রন্থের প্রণেতা নিজের সহীহ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘আয়েশাকে জিজ্ঞেস করা হল, লোকদের মধ্যে কে আল্লাহর রাসূলের সবচেয়ে প্রিয়?

তিনি বলেন: ফাতেমা। জিজ্ঞেস করা হল: পুরুষদের মধ্যে? তিনি বললেন: তার স্বামী আলী।

(মাহমুদ শাহাবী রচিত ‘ইসলাম ওয়াশ শিয়া’ গ্রন্থ হতে সংকলিত)

সহীহ মুসলিম:

মুসলিম বিন হাজ্জাজ কুশাইরী (মৃত্যুকাল ২৬১ হিজরী) স্বীয় প্রসিদ্ধ সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: ‘ফাতেমা মহানবী (স.) এর দেহের অংশ। যে তাকে কষ্ট দেয় সে মহানবীকে কষ্ট দিয়েছে এবং যে তাকে খুশী করে সে মহানবীকে খুশী করলো।

মুসনাদে হাম্বাল:

অন্যতম সুন্নি মাযহাবের (হাম্বালী) ফিকাহে’র প্রণেতা ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল স্বীয় মুসনাদের তৃতীয় খণ্ডে নিজের বিশেষ সনদে মালেক ইবনে আনাস হতে বর্ণনা করেছেন যে,

‘দীর্ঘ ছয় মাস যাবত মহানবী (স.) যখন ফজরের নামাযের জন্য ফাতেমা’র গৃহে সামনে দিয়ে যেতেন তখন বলতেন: ‘নামায! নামায!‍ হে আহলে বাইত’… অতঃপর তিনি

((إنما یرید الله لیذهب عنکم الرجس اهل البیت و یطهرکم تطهیرا)) –এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতেন।(সূরা আহযাব-৩৩)

খ্রিষ্টান চিন্তাবিদ সুলাইমান কাত্তানী’র দৃষ্টিতে নারীকূলের শিরোমনি

হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বাণী ও রচনা রয়েছে যেগুলোর সংখ্যা অত্যাধিক, চাই তা বন্ধুদের পক্ষ হতে হোক বা শত্রুদের। বিশেষ করে বিজ্ঞ ও ন্যায়নীতিবান শত্রুদের পক্ষ হতে।

লেখক যখন এ অধ্যায়টি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন তার সম্মুখে বিশ্বের বিভিন্ন লেখক ও  চিন্তাবিদদের শত শত গ্রন্থ রয়েছে। ঐ সকল মন্তব্য ও লেখা একত্রে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাধ্য হয়ে কয়েকজন চিন্তাবিদ ও লেখকের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা হল।

লেখনী’র এ অংশে অমুসলিম চিন্তাবিদদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমে ‘সুলাইমান কাত্তানী’ নামক এক খ্রিষ্টান সাহিত্যিক, লেখক ও কবির মন্তব্য দিয়ে শুরু করতে চাই। যিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থও রচনা করেছেন যা ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছেন।

তার সম্পর্কে অধিক জানতে এটা জানা জরুরী যে, কয়েক বছর পূর্বে নাজাফের আরবি-ইসলামি গ্রন্থাগার কর্তৃক আরব লেখকদের মাঝে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যাতে প্রতিদ্বন্দিরা মুত্তাকিদের মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এর সম্পর্কে রচনা লিখে উক্ত প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেন।

ঐ প্রতিযোগিতায় বিশিষ্ট লেবাননীয় সাহিত্যিক ও কবি জনাব সুলাইমান কাত্তানী ‘আল ইমাম আলী নাবরাস ও মেতরাস’ শীর্ষক গ্রন্থ লিখে অংশগ্রহণ করে। ঐ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকল লেখা ও গ্রন্থাদি পর্যালোচনার পর সুলাইমান কাত্তানী’র গ্রন্থটি প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয় এবং লেখক প্রথম পুরস্কার লাভ করেন।

দ্বিতীয় বার একই গ্রন্থাগার হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এর ব্যক্তিত্বের উপর প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। এবারও তিনি ‘ফাতেমাতুয যাহরা, ভিতরুন ফি গামাদিন’ শীর্ষক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে প্রথমস্থান অধিকার করে প্রথম পুরস্কারটি জিতে নেন।

যদিও প্রথম অবস্থায় এ ধারণা করা হচ্ছিল যে, যেহেতু লেখক একজন অমুসলিম তাই তাকে উত্সাহিত করার উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার লেখা অধ্যয়নের পর স্পষ্ট হল যে, সে এ পুরস্কারের যোগ্য ছিল। কেননা তিনি একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লেখকদের সাথে একজন ইসলামি ব্যক্তিত্বের জীবনী ও ব্যক্তিত্বের উপর গ্রন্থ রচনা পূর্বক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং তার ঐ বইসমূহ হতে এও স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য বিষয়টিতে পৌঁছুতে পেরেছেন। সুতরাং যদি তার গ্রন্থটি প্রথম স্থান অধিকার করে তবে তাতে কোন কথা থাকার কথা নয়। কেননা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) একজন ঐশী ও বিশ্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী যার ব্যাপারে লেখার অধিকার সকলের রয়েছে। যদিও বন্ধুর কথাকে শত্রু বা মিত্র যে কারও মুখ হতে শুনতে ভাল লাগে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে ‘আল ফাজলু মা শাহেদতু বিহিল আ’দা’ গ্রন্থটি।

বর্তমানে জামিলা বু পাশা, ইন্দ্রা গান্ধি, ফ্লোরেন্স, এলিজাবেথ ও বিনতুল হুদা’র ন্যায় ব্যক্তিত্বের জীবনীর উপর সমগ্র বিশ্বে আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এখানে কি এটা সমিচীন নয় যে, বেহেশতের নারীকূলের সর্দারিনী, সর্বশ্রেষ্ঠ নারী, বিশ্বনবীর প্রাণপ্রিয় কন্যা, বেহেশতের যুবকদের সর্দারের মাতা হযরত ফাতেমা যাহরা ( আ.) এর জীবনীর পরিচয় তুলে ধরা?

জনাব সুলাইমনা কাত্তানী তার গ্রন্থের শুরুতে লিখেছেন:

‘ফাতেমা যাহরা (আ.) এর মর্যাদা এর উর্দ্ধে যে, ইতিহাসের প্রমাণ এবং রেওয়ায়েত তার ব্যক্তিত্বের প্রতি ইশারা করবে, এতটাই সম্মানিত যে, জীবনী ভিত্তিক লেখা গ্রন্থসমূহ তার পরিচয় তুলে ধরবে। ফাতেমা যাহরা ( আ.) এর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তিনি মুহাম্মাদ (স.) এর কন্যা ও আলী (আ.) এর স্ত্রী, হাসান ও হুসাইন (আ.) এর মাতা এবং বিশ্বের নারীদের সর্দার’।

(ফাতেমা যাহরা ভিতরুন ফি গামাদিন, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৩)

তিনি তার গ্রন্থের শেষাংশে লিখেছেন: ফাতেমা, হে মোস্তফা’র কন্যা! হে সর্বোচ্চ উজ্বল চেহারার অধিকারী যাকে পৃথিবী নিজের কাঁধে স্থান দিয়েছে, তুমি শুধুমাত্র দুইবার মুচকি হেসেছো; একবার নিজের বাবার সম্মুখে যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়ে ছিলেন এবং তোমাকে তার সাথে অতি দ্রুত সাক্ষাতের সুসংবাদ দিলেন। আর দ্বিতীয়বার তোমার মুচকি হাসিটি তোমার সমগ্র ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়েছিল যখন ছিল জীবনের শেষ মুহূর্তে তুমি তোমার শেষ নিঃশ্বাসটি ছেড়ে দিলে… তুমি সর্বদা ভালাবাসার সাথে জীবন যাপন করেছো, তুমি পবিত্রতার সাথে জীবন-যাপন করেছো…

তুমি পৃথিবীকে উপহাসব্যাঞ্জক মুচকি হাসির সাথে পরিত্যাগ করে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে রওনা হয়েছো। হে নবী কন্য! হে আলী’র স্ত্রী! হে হাসান ও হোসাইনের মাতা, হে সকল যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী’।

(প্রাগুক্ত গ্রন্থের অনুবাদ, পৃ. ২)

ফরাসী গবেষক লুঈ মাসিনিউন:

প্রখ্যাত ফরাসী প্রাচ্যবিদ ও গবেষক লুঈ মাসিনিউন, যিনি নিজের জীবনের বেশ কয়েকটি বছর হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) কে চেনার কাজে ব্যয় করেছেন। তার এক গবেষণা লব্ধ প্রবন্ধে নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর মোবাহেলা, –যা ১০ম হিজরীতে মদিনায় সংঘটিত হয়েছিল- সম্পর্কে লিখেছেন, যাতে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি তার ঐ প্রবন্ধে বলেন: আওরাদ ও হযরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়াসমূহে ১২টি নূরে সংবাদ দেয়া হয়েছে যারা ফাতেমা কেন্দ্রিক…

মুসার তাওরাত গ্রন্থেও মুহাম্মাদ (স.) ও তার বরকতপূর্ণ কন্যা এবং ইসমাঈল ও ইসহাকের (হাসান ও হুসাইন) ন্যায় তাঁর দু’টি সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।

ঈসা (আ.) এর ইঞ্জিলেও আহমাদ (স.) এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। আরো সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, তিনি একটি বরকতপূর্ণ কন্যা সন্তানের অধিকারী হবেন, যে দু’টি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে…’।

আব্দুর রাহমান বাদাভী’র ব্যক্তিত্ব (যারা সাথে মোবাহেলার বিষয়টিও এসেছে), লুঈ মাসিনিউন, পৃষ্ঠা ১৭৯, ১৯৪৪ সালে মিলানে প্রকাশিত।#

সূত্র: ইন্টারনেট

Facebook Comments