আলম শামস,অপরাজিতা ডেস্কঃ ১৯৭১। পৃথিবীর ইতিহাসে যুক্ত হলো নতুন দেশ। নাম তার বাংলাদেশ। আমরা পেলাম নতুন মানচিত্র, লাল-সবুজ পতাকা, স্বাধীন ভূখ-। আর এ বিজয় এসেছে এই মাসের ১৬ তারিখে। অনেক অনেক ত্যাগ, লাখ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে কাক্সিক্ষত বিজয়। স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল সমগ্র জনগণের আন্দোলন। এই আন্দোলনে সশস্ত্র যুদ্ধে অনেক নারীর অবদান ছিল।
উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী যেমন ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, তেমনি অসংখ্য নারী নিবেদিত প্রাণে কাজ করেছেন নেপথ্যে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, খাবার, ওষুধ-পত্র সরবরাহ করে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন বিপুলসংখ্যক নারী। স্বামী, ভাই, সন্তানকে প্রেরণা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন অগণিত নারী। তাদের সহযোগিতায় আন্দোলন, স্বাধীনতা, বিজয় সফল হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে, নারী জাতির যে অবদান রয়েছে, তা শুধু আমাদের দেশেই নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, যুগে যুগে অন্ধকার, পশ্চাৎপদতা ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রামের যে ইতিহাস রয়েছে তা নারী-পুরুষের যূথবদ্ধ সংগ্রামের ইতিহাস।
সভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষ কেউই একক কৃতিত্বের দাবিদার নয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ কোনো কিছুতেই নারীরা পিছিয়ে থাকেননি। আন্দোলন করতে গিয়ে তারা জেল খেটেছেন, সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছেন, বর্বর, অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। আমাদের দেশে বিজয়ের ৪৩ বছর পরও নারীরা বঞ্চিত অহহেলিত নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছেন। নারীর আর্তনাদ আজও আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নারী নিজ ঘরে অর্থাৎ পরিবারের সদস্য যেমন বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, শ্বশুর, দেবর, ননদ এদের দ্বারাই নির্যাতিত হচ্ছেন। পরিবারে যেন মেয়েদের নিজস্ব কোনো অধিকার নেই। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় দেখা যায় স্বামী, শশুর-শাশুড়ি, ননদ কর্তৃক নির্যাতনের খবর। নির্যাতনের কথা বলার মতো জায়গা ঘরে-বাইরে কোথাও নেই। সাহস করে বললে আপন লোকেরাও দোষারোপ করে। এ নির্যাতন গ্রাম থেকে শহরে, বিত্তহীন থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সর্বত্র বিরাজমান। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা সামাজিক ও পারিবারিক চাপে পরিবারের নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করেন। পরিবারের গ-ি থেকে বের হওয়া দুরূহ ব্যাপার। একদিকে সামাজিক অপবাদ, অপরদিকে আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার অভাবে একজন নারী তার স্বাভাবিক প্রতিভা বা গুণ বিকাশে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
মানুষ হিসেবে নারী তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অধস্তন ও বৈষম্যমূলক অবস্থায় আছে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। অনেক সময় দেখা যায় ইভটিজিংয়ের কারণে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সমাজে বিভিন্ন স্তরে যে যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা যদি নারী প্রসঙ্গে নেতিবাচক কথা না বলেন, ইতিবাচক মন্তব্য করেন, বক্তৃতা বিবৃতিতে যা বলেছেন তা যদি কার্যকরী করেন তবে অনেকটা সহজ হবে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক সময় দেখা যায়, কথা ও কাজে মিল নেই। যিনি নারীদেরকে ভোগের সামগ্রী হিসেবেই দেখেন ব্যক্তিগত জীবনে এমন একজন যদি কোনো এক এলাকায় নেতা বা শাসক থাকেন তার কাছে নারী নির্যাতনের কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেয়ারই কথা। তিনি তো বলবেনই ‘এখন তো পুরুষরা নির্যাতিত হচ্ছে। তাই পুরুষ নির্যাতন আইন হওয়া উচিত।’ আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য বিরাজ করলেও আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রগতিও কম হয়নি।
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ উচ্চতর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করছেন হাজার হাজার ছাত্রী। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন অগণিত ছাত্রী। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মোট ছাত্র সংখ্যার অর্ধেক ছাত্রী। সরকারি বেসরকারি অফিসগুলোতেও কাজ করছে অসংখ্য নারী। উচ্চতর পদগুলোতেও নারীরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্ট শিল্প মূলত টিকে আছে নারীর শ্রম সাধনায়। কিন্তু এই শিল্প নিয়েও চলেছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। গার্মেন্ট ও অন্যান্য শিল্পে নারী শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন। এই শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধেও লড়াই ও আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে এবং সুফল হবে এটা নিশ্চিত। কারণ কোনো আন্দোলনই বৃথা যায় না। সুফল পেতে শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের জনগণ পত্র-পত্রিকায় এবং টিভি খুললেই দেখেছেন অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও হরতালের সময় বিনা কারণে কীভাবে নারীদের গ্রেফতার এবং লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এমপি, আইনজীবীসহ অসংখ্য নারীকে গ্রেফতার এবং নির্যাতন করা হচ্ছে অথচ মানবাধিকার তথা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়েই এদেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। সমাজের ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেই আমাদের বিজয় সার্থক হবে। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি নারী অধিকার তথা মানবাধিকারের গলা টিপে হত্যা করে বিজয়ের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। নারীর প্রতি সম্মান, সহযোগিতা, সহমর্মিতা প্রদর্শন করে নারীকে এগিয়ে যেতে দেশে সকল নাগরিক স্ব স্ব স্থান থেকে এগিয়ে আসবেন মহান বিজয়ের মাসে এটাই নারী সমাজের প্রত্যাশা।
সূত্র- ইনকিলাব।