banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 720 বার পঠিত

 

মায়েদের সচেতনতাই পারে শিশুকে সুন্দর জীবনের হাসি হাসতে

 

যশোর থেকে হাসান সোহেল : পাপিয়া আক্তারের (৩০) দ্বিতীয় সন্তান রীতার বয়স ৫ মাস। এ পর্যন্ত তিনি রীতাকে বুকের দুধ ব্যতীত পানিও খাওয়াননি। পাপিয়া জানান, তার প্রথম সন্তান ঋত্মিকের জন্মের পর এ সব নিয়ম মানেননি। বুকের দুধও ঠিক মত হয়নি। তাই জন্মের কয়েকমাসের মধ্যেই গরুর দুধ খাওয়াতেন। এতে তার প্রথম সন্তানের সব সময়ই অসুখ লেগে থাকতো। ওজনও তেমনি বাড়েনি। স্বাস্থ্য কর্মীদের সহায়তায় রীতা গর্ভে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সব ধরনের নিয়ম মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলছেন। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোয় অনেক খুশি বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, অন্যান্য শিশুদের চেয়ে তার শিশু অনেক সুস্থ। কীভাবে সুস্থতা বোঝা যায়, জানতে চাইলে তিনি জানান, দিনে ৬ বারের বেশি প্রসাব, হাসি-খুশি এবং শান্ত থাকা। একই সঙ্গে শিশু জন্মের কিছু সময় পর শাল দুধ খাওয়ানোসহ কিছু নিয়ম মেনে চলায়ই স্বাভাবিকভাবে বুকের দুধ আসে। যা তাকে প্রথম সন্তান জন্মের পর পর করানো হয়নি।
কথা হয় একই এলাকার গর্ভবতী সাবিনা ইয়াসমিনের (৩২) সঙ্গে। তিনি জানান, বর্তমানে গর্ভকালীন শিশুর ৭ মাস চলছে। তিনি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অনুযায়ী খাবার, দুপুরে খাবারের পর বিশ্রামসহ নিয়মিত যা করা দরকার অনাগত সন্তানের জন্য তার সবই করছেন। একই সঙ্গে শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ আছেন বলে উল্লেখ করেন।
১১ দিন বয়সের শিশু আহ্নিকার মা কুলসুম বেগম (২৫) জানান, দ্বিতীয় সন্তান আহ্নিকার জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত বুকের দুধ সঠিকভাবে খাওয়াচ্ছেন। শিশুও সুস্থ।
বিউটি আক্তার ও ফারুক হোসেন দম্পতির সন্তান সাইম ফারদিনের বয়স ১০ মাস। বর্তমানে শিশুকে দিনে ৩ বার বুকের দুধের পাশাপাশি ভাত, মাছ, মাংস, ডিমসহ প্রাণীজ খাবার খাওয়ানো হয়। বাইরের কোন খাবার খাওয়ান না বলে জানান। তিনি জানান, জন্মের পর থেকে ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। এখন পর্যন্ত শিশু সুস্থ। ওজনও স্বাভাবিক।

এভাবেই পুরো শার্শা উপজেলায় শিশুদের পুষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এলাকায় ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী এবং সেবিকাদের সহায়তায় গর্ভবতী নারী এবং মায়েরা জানেন শিশু জন্মের আগে এবং পরে শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতে ও শিশুর সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে নিজেরাই ভূমিকা পালন করছেন। শুধু শার্মা নয়; সরকারি, বেসরকারি ও অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ থেকে অপুষ্টি নিরসনে সমন্বিতভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, মা ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ গর্ভবতী মা’কে কমপক্ষে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা এবং এ সময়ে মায়েদেরকে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
শার্শা উপজেলায় পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্র্যাকের পুষ্টি প্রকল্পের কর্মসূচি সমন্বয়ক ফায়জুল হাসান বলেন, এই উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম বেশ ভালো। একসময়ে এই এলাকায় বিকল্প শিশুখাদ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অপতৎপরতা বিদ্যমান ছিল। ওদের প্ররোচনায় শিশুর জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে কোন ধরনের নিয়ম মানা হত না। মায়ের দুধের পরিবর্তে বিকল্প শিশুখাদ্য খাওয়ানো হতো। ৩ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যার এই উপজেলায় ব্র্যাকের ৩২ জন স্বাস্থ্য কর্মী, ২৬৩ জন সেবিকা এবং সরকারি পর্যায়ে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। যাদের নির্দেশনায় এখন শিশুদের পুষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এলাকার মায়েরাও অনেক সচেতন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

image_153486
পুষ্টি সম্পর্কিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর পুষ্টিমান ধরে রাখতে গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যা শিশুর ভ্রুণের মস্তিষ্ক, হাড় ও অঙ্গ-প্রতঙ্গ গঠন ও বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। একই সঙ্গে জন্মের পর একটি শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের অন্যতম মাধ্যম ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো। পরে শিশুর বয়স ৬মাস পূর্ণ হলে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে উঠার জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি সুষম বাড়তি খাবার প্রদান করা। গবেষণায় আরও ওঠে এসেছে, অপুষ্টির কারণে শিশুর জীবনের প্রথম ১০০ দিনের যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। এর ফলে মস্তিষ্কের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শিশুর বুদ্ধি কম হয়, লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ে। শারীরিক গঠন দুর্বল ও অপরিণত এবং পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই শিশুর এই সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, মা ও শিশুদের অপুষ্টি  থেকে রক্ষায় পুষ্টিকে মূল ধারায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং পুষ্টি কার্যক্রমকে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৩টি মন্ত্রণালয় পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের একত্র করে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি ব্যাপকভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক প্রতিবেদনে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর অপুষ্টি, প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির তথ্য ওঠে এসেছে। একই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু তহবিলসহ (ইউনিসেফ) বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলছে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ উল্লেযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ কমেছে।
যশোর জেলার সিভিল সার্জন ডা. আতিকুর রহমান খান বলেন, শিশুদের অপুষ্টির বিষয়ে গ্রামে গ্রামে বৈঠক করে দীর্ঘদিন থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। একই সঙ্গে শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে এখনো অনেক সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমরা যতই মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করি শিশু খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ততই চাতুর্য্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করছে। তাই এই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হতে হবে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সচেতনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম কিউ কে তালুকদার মা ও শিশু অপুষ্টি রোধে প্রাথমিক ও দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়ে বলেন, প্রাথমিকভাবে শিশুদের ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। পরবর্তীতে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ৬ মাস পর থেকে শিশুদের ঘরে তৈরি সুষম খাবার দিতে হবে। একই সঙ্গে মা ও শিশুদের জন্য ক্ষতিকর খাবারের ব্যাপারে নজরদারি রাখতে হবে। এটা করতে পারলেই সুস্থ-সুন্দর প্রজন্ম তৈরি হবে। তিনি বলেন, মায়ের দুধ শিশুদের সুন্দরভাবে, সুস্থ হিসেবে গড়ে তোলার একমাত্র খাবার। মায়ের দুধের বিকল্প আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। তাই এর গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে বেশি করে বোঝাতে হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রাইসুল হক বলেন, পুষ্টি কার্যক্রমে অনেক সফলতা এসেছে। এরপরও এ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে হবে। এছাড়াও তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে মা’দের পৃথকভাবে কাউন্সিলিং করানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

 

Facebook Comments