জান্নাতুন নুর দিশা
একসময় এদেশের মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট ছিলো না, কিন্তু মনুষ্যত্ব ছিলো। এখন যা অবস্থা হয়েছে এদেশের মায়েরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তবে অনেকেই হারাচ্ছেন মনুষ্যত্ব।
দুয়েকটা উদাহরণ দেই।
শিক্ষকতা পেশায় আছি সাড়ে তিন বছর। প্রথম যোগদান করেছিলাম এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে।
সেখানে যে কিছুদিন পড়িয়েছি, বাচ্চাদের মায়েদের অদ্ভুত কিছু মনোভাব দেখিছি।
একবার স্কুলের মিডটার্ম পরীক্ষায় ক্লাস টু’তে পড়ুয়া এক বাচ্চার ব্রাইটার গ্রামার পরীক্ষার খাতা নিয়ে এলেন বাচ্চার মা। খাতা মূল্যায়ন করেছিলাম আমি।
ভদ্রমহিলার দাবী ছেলে একশোতে একশোই পাবে, আমি দিয়েছি সাতানব্বই! প্রিন্সিপাল আমাকে ডাকলেন।
এমন ভুল হবার তো কথাই না আমার। খাতা দেখলাম উল্টেপাল্টে। বাচ্চা যে দুটো ওয়ার্ড মিনিং ভুল করেছিলো, পেন্সিলে লেখা হওয়ায় বাচ্চার মা ভুল বানান দুটো মুছে নিজে শুদ্ধ বানানটা লিখে নিয়ে এসেছে! উদ্দেশ্য নিজের বাচ্চাককে ফার্স্ট বানানো, এই তিন নাম্বার কম পাওয়ায় ওনার বাচ্চা ফার্স্ট না হয়ে সেকেন্ড হয়েছে।
যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে ছেলের লেখার মত করে লিখতে, তবু অন্যান্য লেখার সাথে মিলিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো এই লেখাটা বাচ্চাটার ছিলো না। প্রিন্সিপাল আর আমি দুজনেই বাচ্চার মা’কে বুঝিয়ে বললাম ওনার এই জালিয়াতি আমরা ধরতে পেরেছি।
এই ভদ্রমহিলা গ্রেজুয়েট। উনি যখন ভুল উত্তর মুছে শুদ্ধ উত্তর লিখে দিচ্ছেন খাতা হাতে পাবার পর, নিশ্চয়ই বাচ্চা পাশে বসে ছিলো। এই বাচ্চাটা তার জীবনের প্রথম শিক্ষক তার মায়ের কাছ থেকে এত ছোট বয়সেই প্রতারণা শিখে নিয়েছে। বড় হয়ে এসব বাচ্চা যদি প্রতারণা, দুর্নীতি করে দায়ভার কার?
আরেকটা ঘটনা বলি, ক্লাস থ্রিতে একটা ফুটফুটে বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে পড়তো নাম মিতা। আমি খুব স্নেহ করতাম মেয়েটাকে। মেধাবী ছিলো। মিতা মেয়েটা একবার ইংরেজি বই হারিয়ে ফেললো। বাসায় মায়ের বকার ভয়ে মিতা মা’কে বলেছিলো বই মিসকে দিয়েছিলাম, মিস হারিয়ে ফেলেছে।
বাচ্চার মা মেয়েকে দিয়ে আমার কাছে একটা কাগজ পাঠালো। কাগজে লেখা, “আপনি আমার মেয়ের বই হারিয়েছেন, ওকে বই কিনে দেবেন!”
এই কাগজ আমার হাতে দিয়ে মেয়েটা লজ্জায় অঝোর ধারায় কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মিস, বইটা আমিই হারিয়েছি। মা মারবে বলে আপনি হারিয়েছেন বলেছি। এখন মা আমাকে বলেছে আপনার কাছে বই চাইতে। আমি পারবো না বলায় এই কাগজ আপনাকে দিতে বলেছে।”
ভদ্রমহিলার এই আচরণ আমাকে অবাক করেছিলো প্রচণ্ড। মিতাকে পরের দিন ঐ হারিয়ে যাওয়া টেক্সট বই সাথে দুটো গল্পের বই রেপিং পেপারে মুড়ে উপহার দিলাম।
এরপর মিতার মা যতবার স্কুলে এসেছে, লজ্জায় আমার দিকে আর তাকাতে পারে নি।
আজকালকার অভিভাবকদের এমন অসংখ্য নীতিহীন আচরণ আমি শিক্ষকতা পেশায় থেকে দেখেছি, দেখছি।
ছোট ছোট প্লে, নার্সারির বাচ্চাদের পরীক্ষার হলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মায়েদের উত্তর বলে দেয়া, চিরকুটে উত্তর লিখে দেয়া, বাচ্চা ফার্স্ট, সেকেন্ড না হলে মারধোর করা অদ্ভুত অসুস্থ সব আচরণ। যতটা প্রতিযোগিতা না বাচ্চাদের থাকতো, তারচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা অভিভাবকদের।
কচি মনগুলোকে খুব ছোট বয়স থেকেই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে মায়েরাই। এসব বাচ্চারাই বড় হয়ে আত্মহত্যা করে হতাশায়।
প্রচন্ড রকম মানসিক শক্তিহীন একটা প্রজন্ম গড়ে দিচ্ছে এ যুগের মায়েরা, এদেরই বড় হয়ে মোটিভেশন প্রয়োজন হয়। এদের সেল্ফ কনফিডেন্স, সেল্ফ মোটিভেশন পাওয়ার শৈশবেই নষ্ট করে দেয়া হয়।
এখনকার মায়েরা চাঁদ মামার ছড়া শোনানোর বদলে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছে দশ-বারোটা শক্ত শক্ত বই। মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর যত কঠিন হিসাব, “তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে”।
অথচ ফার্স্ট হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।