banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 365 বার পঠিত

 

মাতৃকথন_১০

মাতৃকথন_১০


ফারিনা মাহমুদ


নিছক নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিতে লেখা শুরু করেছিলাম মাতৃকথন । খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ধীরে ধীরে বেশ অনেকেই আমাকে ইনবক্সে কমেন্টে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন বাচ্চার ব্যাপারে । তাঁরা সবাই জানেন আমি ডাক্তার নই, শিশু বিশেষজ্ঞও নই। তাহলে আমার কাছে ক্যানো ? আমার মনে হয়েছে আমার কথাগুলো হয়ত খুব সাধারণ, আটপৌরে বলেই অনেকের সাথে মিলে গেছে । কাছের মানুষ ভেবেই তাঁরা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, চাইছেন । এ এক পরম পাওয়া আমার জন্য । শুরু থেকে ব্যাপারগুলো এলোমেলো ছিলো । এখন ভাবছি একটু গুছিয়ে শুরু করবো । যদি একজনেরও একটু উপকার হয়, আমি ধন্য ।

#পৃথিবী_বদলে_গেছে…. যা দেখি নতুন লাগে !

দীর্ঘ অপেক্ষার পর কোলে যখন শিশুটা আসে,সে একা আসে না । নতুন মা বাবার জন্য নিয়ে আসে একরাশ আনন্দের বিপরীতে কিছু দুশ্চিন্তা, পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন, নির্ঘুম রাত আর কি করবো কি করবো না এই দ্বিধার দোলাচল । এই নতুন পরিস্থিতিতে কিভাবে খাপ খাওয়াবেন বাবা মা ? কিভাবে কি করবেন দিশা পাওয়ার আগেই আরো কিছু সমস্যা হাজির হয় । মা আর বোনেরা এই করতে বলছেন তো শ্বাশুড়ি ননদ ঠোঁট উল্টে বললেন – যত্ত সব ঢং ! এইভাবে বাচ্চা পালে নাকি ? স্বামী বেচারা অটো হয়ে যান দু পক্ষের কথা শুনতে শুনতে । ফলাফল – সম্পর্কের অবনতি, রাগারাগি ঝগড়াঝাটি !

ব্যাপারগুলো ক্যানো ঘটে ?

ঘটে মূলত আমাদের অজ্ঞতা ও মানসিক প্রস্তুতির অভাবে । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাবা মায়েরা নতুন বাচ্চা এবং প্রসুতি মায়ের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানেন না । ভাবেন নানী দাদী তো আছেই ! কিন্তু মনে রাখতে হবে, দিনশেষে বাচ্চাটা যেহেতু আমার, তাই আমারই দায়িত্ব বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া । আমার মতে বাচ্চার জিনিসপত্র, নাম আর ঘর সাজানো নিয়ে মাথা ঘামানোর পাশাপাশি কিছু দরকারী বিষয় জেনে নেয়া জরুরি ।এতে করে সন্তান জন্ম পরবর্তী চ্যালেঞ্জ গুলো মোকাবেলা করা সহজ হয় ।

১) মায়ের পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন :
প্রসব পরবর্তী ম্যাসিভ হরমোনাল চেঞ্জের কারণে নিজের ইমোশনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না । প্রচন্ড রাগ, জিদ, অকারণে কান্না এই ধরনের কিছু অদ্ভূত উপসর্গ দেখা দেয় । মা নিজেও মোটামুটি তব্দা খেয়ে যায় তার নিজের আচরণে। অসম্ভব অসহায় লাগে নিজেকে । মনে হয় কেউ আমাকে বুঝতে পারছে না ।
অদ্ভূত ব্যাপার হছে, একটা সমময় নিজেকে খুব উপেক্ষিত আর বঞ্চিত মনে হয় । মনে হয় সবাই শুধু বাচ্চা বাচ্চা করে যাচ্ছে ক্যানো, আমি কি একটা মানুষ, না মানুষের ছায়া ! বিশেষত গর্ভাবস্থায় সবার আদর যত্ন পেয়ে এসে এই নতুন পরিস্থিতিতে হঠাত খুব খটকা লাগে ! ক্লান্ত অবসন্ন আপনার মাথায় আবার সারাক্ষণ সেই বাচ্চাকে নিয়েই টেনশন, বাচ্চাটাকে কারো হাতে দিয়ে শান্তি পাওয়া যায়না । মনে হয় চারপাশের সবাই ভুল, আমি ই শুধু ঠিক ।
কি করবেন : এই করনীয়র তালিকাটা মূলত অন্যদের জন্য, আরো আলাদা করে বললে বাবা দের জন্য । সাপোর্টিং পার্সন হসাবে তাদেরকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হবে এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে, এইটা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, আপনাদের দায়িত্ব মা কে সময় দেয়া, কাজ ভাগ করে নিয়ে বিশ্রামে সহায়তা করা । তাকে আঘাত করে বা দোষ দিয়ে কথা না বলা এবং কেউ যাতে বলতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া । তার রাগ জিদ ধরে আপনিও তার সাথে বাক বিতন্ডায় জড়াবেন না যেনো । তর্ক বাড়ছে বুঝলে ব্রেক নিন । কিছুক্ষণ বাইরে থেকে হেঁটে ফিরে আসুন । তাকেও কুল ডাউন টাইম দিন, নিজেও নিন । অবস্থা বেশি খারাপ হলে অবশ্যই চিকিত্সা সেবা নেবেন । তবে অবশ্যই আত্মীয়ও স্বজন, শ্বশুর বাড়ি বাপের বাড়ি এক করে বিচার সালিশ বসিয়ে আরো বড় বিপদ ডাকবেন না ।

২) ঘুম স্বল্পতা :
সদ্যজাত বাচ্চার পিছনে দিন রাত এক হয়ে যায় । বাচা খাওয়ানো, ঘুম পড়ানো, কাঁথা পাল্টানো, কান্না সামলানো এই লুপের মধ্যে পড়ে যায় মা । আমি নিজেই মাথায় চিরুনি দিয়েছিলাম ১৯ দিন পরে, এমনও দিন গেছে যখন ২৪ ঘন্টায় একবার খাবার সময় পেয়েছিলাম ! ভোজবাজীর মতো পাল্টে যাওয়া এই নিদ্রাহীন কান্ত জীবন ভীষণ প্রভাব ফেলে বাবা মায়ের উপরে, প্রভাব ফেলে সম্পর্কের উপরেও । মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে । বাবাদের জন্য অফিসে কাজে মন বসানো খুব কষ্টকর হয়ে যেতে পারে ।
কি করবেন : ঘুমাবেন । সোজা হিসাব হচ্ছে যখন ই একটু সুযোগ পাবেন, ঘুমিয়ে নেবেন । প্রথম ৬ সপ্তাহ বাচ্চার রুটিনের সাথে নিজে মানিয়ে নেয়া ছাড়া গতি নেই । বাচ্চা ঘুমালে এই করবো সেই করবো না করে নিজেও শুয়ে পড়বেন । হালকা তন্দ্রা বা বিশ্রামও আপনাকে অনেক ঝরঝরে করে তুলতে পারে । ২৪ ঘন্টায় কয়েকটা ছোট ন্যাপ নিলেও দেখবেন বাকি সময়টা অনেক ভালো কাটবে ।

৩) ক্ল্যাশিং প্যারেন্টিং স্টাইল :
ওই যে শুরুতে বললাম,বাবার বাড়ি থেকে বলেছে তেল ডলতে শ্বশুর বাড়ি বলছে না … এই ধরনের ক্ল্যাশ খুব কমন । এক একজনের বাচ্চা পালার তরিকা ও অভিজ্ঞতা এক এক রকম হয় । সবাই ভাবে সে ঠিক । এতে করে তৈরী হয় একটা সংঘাতময় অবস্থা । এর স্বীকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা । যেন মা ছাড়া দুনিয়ার সবাই সব জানে !
কি করনীয় : নিজেকে জানতে হবে কি করবো, কেন করবো । কনফিডেন্স রাখতে হবে নিজের উপরে । মানুষের বাচ্চা কোনো নতুন মডেলের গাড়ি না যে ম্যানুয়াল সাথে নিয়ে পৃথিবীতে আসবে । তবে হ্যা, সব গাড়ির কমন মেকানিজম থাকে । সেইটা জেনে রাখলে অন্যের কথা খুব বেশি আমল দেয়ার প্রয়োজন নেই যদি না যুক্তি যুক্ত মনে হয় । সবকিছুতে উদ্বিগ্ন হবেন না । তবে উদ্বিগ্ন কখন হতে হয় সেই বেসিক পয়েন্ট গুলো জানতে হবে।

৪) একান্ত সময় থেকে বঞ্চিত :
বাচ্চা হবার আগে প্রতি সপ্তাহে দুজনে রিক্সার হুড ফেলে ঘুরতে যেতেন? রাত জেগে মুভি দেখতেন ? আড্ডা দিতেন বন্ধুদের সাথে? আর এখন? নিজেদের বসে দুটো কথা বলার সময়ও নেই ! আর কি কোনদিন জীবন স্বাভাবিক হবে ?
কি করনীয় : জীবন স্বাভাবিক হবে আবার, তবে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে দুজনকেই । বাচ্চার কাজগুলো দুজন মিলেই করুন । বাবা যখন বাচ্চার কাজ করতে চাচ্ছেন, মা তখন তাকে খবরদারি করা থেকে বিরত থাকুন, তাকে বুঝিয়ে দেখিয়ে দিন কি করলে ভালো হয় । তিনি একবারে না পারলেই গলা চড়াবেন না । আর একেবারে আপনার মতো করেই তাকে পারতে হবে এমন কথা নেই । একটু উনিশ বিশ হলে দুনিয়া উল্টে যায় না । ধৈর্য রাখুন, বাচ্চাকে একটা রুটিনে আনতে পারলে সব ই সম্ভব হবে । নিজেরা নিজেদের জন্য সময় বের করুন । সমঝোতা শক্ত করুন । একে অপরের পাশে থাকুন । একটু একটু করে প্রিয় জিনিসগুলো ফিরিয়ে আনুন ।
এই চাল্যেঞ্জ গুলো প্রথম ৬ সপাহে যদি ভালো মতো হ্যান্ডেল করতে পারেন, বিশ্বাস রাখেন, ৬ সপ্তাহের পর থেকে পরিস্থিতি অনেক অনেক ভালো হবে !
ফিরে আসবো পরের পর্বে, নবজাতকের যত্ন নিয়ে !

Facebook Comments