banner

সোমবার, ০৯ Jun ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 14 বার পঠিত

 

মন্থর জীবনের আহ্বান: ক্লান্ত পুঁজিবাদের যুগে ‘কিছু না করা’র বিপ্লব

ধীরে চলা, বিশ্রামের জন্য সময় বের করা: এ কি শুধু বিলাসিতা, নাকি এক জরুরি প্রয়োজন?

আজকের ব্যস্ত, প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনে, যেখানে মানুষ প্রতিদিন ‘আরো করো’ সংস্কৃতির শিকার, সেখানে ‘কিছু না করা’ হয়ে উঠছে এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ! এক নতুন জীবনদর্শন!

একটি বছর শুধু বিশ্রামে কাটানো, কেমন শোনায়?
নেই অফিস, নেই ইমেইল, নেই ক্যারিয়ারের দৌড়ঝাঁপ-শুধু নিজেকে সময় দেওয়া।
এক সময় এটা ছিল “ব্যর্থতা”র প্রতিচ্ছবি, কিন্তু আজ তা হয়ে উঠেছে আত্মউপলব্ধির পথ। এই ধরণের ধীর জীবনচর্চা এখন পুঁজিবাদী ব্যস্ততার বিরুদ্ধে এক নীরব বিপ্লবের রূপ নিচ্ছে।

ব্রিটিশ লেখিকা এমা গ্যানন একসময় ক্যারিয়ার-ভিত্তিক ‘গার্লবস’ কালচারের প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ এক চরম বার্নআউট তাঁর জীবন পাল্টে দেয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, স্ক্রিনের দিকে তাকাতেও কষ্ট হতো, হাঁটতে গেলেও ক্লান্তি ছাপিয়ে যেত। এই অবস্থায় তিনি এক বছর কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরতি নেন।

এই অভিজ্ঞতাই জন্ম দেয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক দুই খণ্ডের বই “A Year of Nothing”। বইটিতে তিনি বলেছেন কীভাবে দিনগুলো কাটিয়েছেন পাখি দেখা, শিশুদের কার্টুন দেখা, জার্নাল লেখা আর ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটার মতো সহজ কিন্তু শান্তিপূর্ণ অভ্যাসে। তাঁর মতে, “ঘুম, আকাশ দেখা, হাঁটাহাঁটি -এগুলো বিলাসিতা নয়, বরং আমাদের মানসিক সুস্থতার অপরিহার্য অংশ।”

‘কাজই যদি জীবনের মানদণ্ড হয়’ – এই বিশ্বাসে ধাক্কা
আজকের সমাজে ‘ব্যস্ততা’কে সাফল্যের মাপকাঠি ধরা হয়। কিন্তু এই ধারণার বিরুদ্ধেই দাঁড়াচ্ছে নতুন প্রজন্ম। অনেক লেখক-চিন্তক এখন বলছেন, বিশ্রামও এক ধরনের হতে পারে অগ্রগতির চালিকাশক্তি।

জেনি ওডেলের “How To Do Nothing” বইটি দেখিয়েছে, কীভাবে প্রযুক্তি আমাদের মনোযোগ চুরি করছে, এবং ‘কিছু না করাও’ এক রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে।

অলিভার বার্কম্যানের “Four Thousand Weeks” মনে করিয়ে দেয়, আমাদের জীবনের সময় সীমিত, তাই তা যেন আমরা ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে না ফেলি।

“নিকসেন” নামে এক ডাচ ধারণা বলছে – ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু না করাটাই নিজেকে সময় দেওয়ার একটি পদ্ধতি।

অক্টাভিয়া রাহিম তাঁর বই “Pause, Rest, Be”–তে যোগব্যায়ামের মাধ্যমে নিজের সঙ্গে সংযোগ তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

ক্লডিয়া হ্যামন্ডের “The Art of Rest” বইয়ে দেখা যায় গবেষণালব্ধ প্রমাণ – বিশ্রাম আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কতটা জরুরি।

এই ‘মন্থরতার’ ঢেউ কোথা থেকে এলো?
এক কথায়- আমরা ক্লান্ত,খুব বেশি ক্লান্ত।
নিত্যদিনের কাজের চাপে, সোশ্যাল মিডিয়ার অপূর্ণতার প্রতিযোগিতায়, স্ক্রিনে আটকে থাকা জীবনে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি। কোভিড-প্যান্ডেমিক অনেককে প্রথমবারের মতো বাধ্য করেছে থামতে, নিজেকে সময় দিতে। সেখান থেকেই অনেকেই বুঝেছেন-ধীরে চলা মানে পিছিয়ে পড়া নয়।

তবে, ‘কিছু না করা’ কি সবার জন্য সম্ভব?
সমালোচকেরা বলেন, এই “বিশ্রামের জীবন” মূলত সেইসব মানুষের জন্য, যাদের আর্থিক সুরক্ষা আছে। সবকিছু ছেড়ে শুধু নিজের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ কি সবার আছে?

এই প্রশ্ন থেকেই স্পষ্ট হয় – ধীরে চলার পথও এক ধরনের প্রিভিলেজ। কিন্তু তাই বলে এই বার্তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় না। বরং এটি মনে করিয়ে দেয় – যতটা সম্ভব, আমাদেরও দরকার কিছুটা থেমে যাওয়া, কিছুটা বিশ্রাম, কিছুটা নিজের খেয়াল রাখা।

‘কিছু না করা’ এখন আর অলসতার প্রতীক নয়। বরং এটি হয়ে উঠছে এক সচেতন সিদ্ধান্ত -প্রযুক্তি, ব্যস্ততা, আর অকারণ চাপের বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটি কৌশল।
বই পড়া, গাছপালায় পানি দেওয়া, কিছু সময় নীরবে বসে থাকা-এসব আজকের দুনিয়ায় এক ধরনের বিপ্লব।

ক্লান্ত এই সময়ে, আপনি কি প্রস্তুত একটু থামতে!

Facebook Comments