মনোজাগতিক অভিযাত্রা (২)
আফরোজা হাসান
হতাশার চোরাবালিতে আকন্ঠ ডুবে থাকা মানুষ প্রায়ই ছুটে আসে একটু আশার আলোর সন্ধানে। কিন্তু তাদের মনের হতাশার গভীরতা এত বেশি থাকে আমার আশা জাগানিয়া শব্দরা সেখানে পৌছা মাত্রই টুপ করে ডুবে যায়। এমন মানুষদের সঠিক পথের দিশা দেখাতে যেয়ে নিজেই দিশেহারা হয়ে যেতাম। কয়েকজন এসেই আকুতি জানাতো ঘুমের ঔষধের। ঘুমিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে যেতে চায়। কাউকেই এমন সমাধান দিতে ইচ্ছে হতো না। ইচ্ছে হতো এমন কোন সমাধান দিতে যাতে অশান্ত প্রাণগুলো প্রশান্তির সন্ধান পাবে আত্মিক ভাবেই। কোন ড্রাগের প্রভাবে কিছুটা সময় ভুলে থাকবে না নিজের সমস্যার কথা। বরং নিজের সমস্যাকে মেনে নিয়ে সেটার সমাধানের চেষ্টা করবে। সমস্যায় দ্বিগিদিক ছোটার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষ আগত সমস্যাকে মেনে নিতেই নারাজ থাকে। যারফলে সমাধান হাতের কাছে থাকা স্বর্ত্বেও নিজ সাধ্যের বাইরে কিছু ভেবে নিয়ে আহাজারি করে, ভীত হয়। মনে পড়লো একটা সময়ে আমি নিজেও এমনটাই ছিলাম। কিন্তু যেদিন মন থেকে সত্যিকার অর্থে মেনে নিয়েছিলাম, দুনিয়াতে এসেছিই পরীক্ষা দিতে। এবং ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, বিপদআপদ ইত্যাদির দ্বারা আল্লাহ পরীক্ষা করবেন। কিন্তু কখনোই আমার সাধ্যের বাইরের কোন বোঝা আমার উপর চাপাবেন না। সেদিন থেকে যে কোন সমস্যাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীটাই বদলে গিয়েছিল আমার। এতই অধৈর্য্য স্বভাবের একজন মানুষ ছিলাম আমি সুপার মার্কেটে লম্বা লাইন দেখলে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে খুঁজে বের করা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখেই চলে আসতাম। কারণ অতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য্য আমার ছিল না। কিন্তু দুনিয়া পরীক্ষা ক্ষেত্র মেনে নেবার পর থেকে এমন পরিস্থিতিতে পড়লেই মনেহতো ধৈর্য্যশক্তি বৃদ্ধির পরীক্ষা চলছে আমার। এমন ছোট ছোট পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই নিজেকে ধৈর্য্যশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে আমাকে।
তারমানে আপনার অপরিসীম ধৈর্য্যশীলতার গোপন রহস্য এখানে লুকায়িত?
এই প্রথম হাসি ফুটে উঠলো সিনিয়র সহকর্মীর চেহারাতে। ব্যক্তি হিসেবে উনি যথেষ্ট হাসিখুশি। উনার রসবোধও চমৎকার। এটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তবে নিজের ব্যক্তি জীবনের আলোচনা বিশেষ করে অতীতের প্রসঙ্গ উঠলেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান। উনার ব্যক্তিত্বের এই অংশটা প্রায় সময়ই চিন্তার খোরাক জোগায় আমার। কর্মজীবনের দীর্ঘ পথে অসংখ্য মানুষকে উনি তাদের অতীতের নিকষ অন্ধকার থেকে মুক্ত সহায়তা করেছেন। অথচ নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি মন্দ অতীতের বাহুডোর থেকে। অবশ্য একজন ক্যান্সার স্পেশালিষ্ট যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে একজন মনোচিকিৎসকও ভুগতে পারেন মনোরোগে। যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
আমার প্রশ্নের জবাবে হাসি মুখে বললেন, তা বলতে পারো। তবে মূল কথা কিন্তু একটাই। যে কোন পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারাটা। কারণ একটি পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারাটাই হচ্ছে সেই পরিস্থিতি থেকে বেরোবার বদ্ধ তালার চাবি। এই কথাটা বোঝার পর থেকে কোন পরিস্থিতিই আর আমার সামনে এগিয়ে যাবার পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারেনি। তাই আমার একটাই চিন্তা ছিল পেশেন্টদের মনে এই একই আত্মপোলব্ধি জাগানো। সমস্যা থেকে পালানোর চেষ্টা না করে ফেস করতে শেখানো। সমস্যার স্বভাবই যত পিছু ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয় পেছন পেছন ধাওয়া করে। কিন্তু যখনই মুখোমুখি দাঁড়ানো হয় একপা, দু’পা করে পিছাতে পিছাতে একসময় ঝেড়ে দৌড় লাগায় এবং হারিয়ে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে।
এই পদ্ধতিটা সত্যিই ফলপ্রসূ। আমার অভিজ্ঞতাও বলে যে কোন সমস্যাকে মেনে নিতে পারাটাই আসলে জয়ের পথের প্রথম কদম। তারপর বলুন..
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি নানারকমের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, ছন্দ-দ্বন্দ্ব নিয়েই আমাদের জীবন। আর এসব তাই পালা ক্রমে আমাদের জীবনে আসতেই থাকবে। সুখ হোক বা দুঃখ কোন অবস্থায় মধ্যেই স্থির থাকা সম্ভব নয় জীবনে। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে মনকে। তখন মনের অন্ধকার কোনে কুরআনের একটি আয়াত জাগিয়ে যায় প্রশান্তির প্রদ্বীপ শিখা। সূরা রা’দ এর ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “যারা ঈমান আনে ও আল্লাহর স্মরণে যারা প্রশান্তি লাভ করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্তি খুঁজে পায়।” আল্লাহর স্মরণের মাঝে প্রশান্তি খুঁজে নিতে পারাটা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তি একবার যদি কেউ হাসিল করে নিতে পারে দুনিয়ার কোন অপ্রাপ্তি আর সেই মনকে স্পর্শ করতে পারে না। এই প্রাপ্তি অর্জন কিন্তু খুব বেশি কঠিন কিছু নয়। এই প্রাপ্তির জন্য শুধু প্রয়োজন নিজ অবস্থানে সর্বাবস্থায় সন্তোষ। যে কোন পরিস্থিতিতেই আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারাটা। এটাও কিন্তু বেশ সহজ। আমাদের জন্য একটা পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক না কেন দৃষ্টি নীচের দিকে করলেই তারচেয়েও নাজুক পরিস্থিতির মোকাবিলায় রত অসংখ্য মানুষের দেখা মেলে। তাই নিজ অবস্থানকে সন্তোষ ভরা মেনে নেবার কথাটাই প্রথম বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম পেশেন্টদের। সেই চেষ্টাটাকে জয়ের মুখ দেখানোটা অবশ্য বেশ কঠিন ছিল।
হুম, যখন কোন পরীক্ষা আসে তখন নিচের দিকে তাকানোর সেন্সটাই কাজ করা ছেড়ে দেয় যেন। নিজেকেই তখন জগতের সবচেয়ে অভাগা মনেহয়। আপনার কখনো নিজেকে এমন মনে হয়েছে? কখনো কি ভেতর থেকে কেউ বলেছে তোমার মতো দুর্ভাগা জগতে কেউ নেই? যদি বলে থাকে ঐ পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে বুঝিয়েছিলেন?
হেসে বললেন, যখন থেকে শরীয়তের আলোকে চিন্তা করতে শিখেছিলাম তখন থেকে আর কখনোই নিজেকে দুর্ভাগা মনেহয়নি। যখনই কোন সমস্যা এসেছে, আমি কোনকিছু চেয়েছি কিন্তু পাইনি। এমন পরিস্থিতি গুলোকে নিজের জন্য পরীক্ষা ভেবে নিয়েছি। যদিও ভাবাটা সহজ হতো না বেশির ভাগ সময়ই। লক্ষ্য থেকে বারবার ফসকে যেতো চাইতো মন। দুঃখবিলাসে মগ্ন হতে চাইতো। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতাম কিছুতেই হাল ছেড়ে না দেবার। আসলে যে কোন পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেবার অসংখ্য কারণ থাকে আমাদের কাছে। কিন্তু হাল ছেড়ে না দেবার জন্য একটা কারণই যথেষ্ট হয়। যেটা হচ্ছে রব্বের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি। জীবনের লক্ষ্যটাকে যদি রব্বের সন্তোষ অর্জনে স্থির করা যায়, তাহলে কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতিতেও আশায় দিয়া নিভু নিভু করে হলেও প্রজ্জলিত থাকে অন্তরে……।