প্রবাসী মজুমদার
মসজিদ হতে মাগরিবের নামাজ পড়ে এসেছি মাত্র। অন্দর মহলে ঢুকতেই নাজুকে চোখে পড়ল। জায়নামাজে চুপ করে বসে আছে। সালামের জবাবটা এত ক্ষীণ ছিল যে, মনে হল কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম
– কি হয়েছে তোমার? এমন করে বসে আছ কেন?
– বুকে ব্যথা।
– বেশী।
– অনেকটা তাই-ই।
– কোন দিকে?
– বা দিকে।
– শুরুটা কিভাবে হল? জানতে চাইলাম।
নাজু বলতে লাগল, নামাজে রুকু থেকে সিজদায় যাবার সময় হঠাৎ বাম দিকে টান লেগেছে। ভেবেছিলাম চলে যাবে। এমনটি মাঝে মধ্যে হয়। কিন্তু কফ দিয়ে কিংবা ম্যাচেজ করেও যেন ব্যথাটি যাচ্ছে না। কিট কিটি ব্যথ্যাটা যেন রয়েই গেল।
– আচ্ছা। ব্যথাটা কি এক জায়গায় আছে, নাকি বাম হতেও ছড়িয়ে পড়ছে?
– না। এক জায়গায়। কিন্তু কেমন জানি মনে হচ্ছে। ইতি পুর্বে এমন আর কখনো অনুভব হয়নি।
– ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
– গেলেই ভাল। আমার খুব ভয় হচ্ছে।
নাজু অসুস্থতাকে সব সময়ই উপেক্ষা করতে অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত সামান্য সর্দি জ্বরের জন্যও হাসপাতালে টেস্টের নামে ডাক্তারদের হয়রানি আর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে থাকা খুবই বিরক্তিকর। হাসপাতালের এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়িয়ে চলার জন্য অনেক রোগীই টোকেন নিয়ে দু এক ঘন্টার মার্কেটিং ও সেরে আসে।
যাইহোক, হার্ট জনিত কারণে নাজু যেহেতু আজ হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে। তাকে এতটুকু ভয় পেতে দেখে আমিও তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। সন্তান দুটোকে বাসাতেই রেখে গেলাম।
বিদ্যুতের গতিতেই হাসপাতালের দরজায় গিয়ে পৌছলাম। আল আবির সাসপাতাল। জেদ্দা। রিসিপশনে লম্বা লাইন।অনেক্ষণ দাড়িয়ে সিরিয়াল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পাকেট থেকে ইনসিওরেন্সের মেডিক্যাল কার্ডটি বের করে এগিয়ে দিতেই রিসিপশনিষ্ট জানতে চাইল,
– কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
– হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাক্তার তাহির।
– সরি। একেবারে ওভার বুকড হয়ে আছে।
– মানে?
– রোগীর সংখ্যা এত বেশী যে, রাত একটায় ও রোগী দেখা শেষ করতে পারবেনা। এখন আর একজন বাড়তি রোগী নেয়ার কথা বললে ডাক্তার আমাকে উল্টো মারবে।
অসহায় রিসিপশনিষ্ট এর কথা শুনে থ হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম
– তাহলে আমি এখন কি করবো? আমাকে যে ডাক্তার দেখাতেই হবে।
– আপনি একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানকে দেখান। ও যদি হার্ট এর ডাক্তার দেখাতে রিকমান্ড করে, তাহলেই আপনাকে রেফার করা যাবে।
তাৎক্ষণিক্ষ রাজী হয়ে গেলাম। জেনারেল ফিজিশিয়ানের সাথে দেখা করার জন্য স্লিপ দেয়া হল। ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম। রোগীর মুখে বিস্তারিত শুনে হাতে আরও একটা স্লিফ ধরিয়ে দেয়া হল। ইসিজি টেস্ট। হার্টবিট দেখতে হবে। না দেখে অগ্রীম কোন কিছু বলা যাবেনা।
মাসের শেষ। পকেটের দাপট অনেকটা ক্ষীণ। দোয়া কালেমা পড়েও টেষ্ট হতে বাঁচার উপায় নেই। তাই অযথা টেস্টের যন্ত্রনায় নিজের হার্টবিট বেড়ে না যাবার জন্য নিজের জন্যও এখন দোয়া পড়ছি।
প্রাথমিক টেষ্ট ইসিজির পয়সাটা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রোগীকে নিয়ে ইসিজি করে সীট দেখিয়ে শুয়ে থাকতে বলল। নাজুর চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অনুমান একেবারে ঠিক। হার্টের কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে। না জানি কি হয়।
অভয় দিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আনার চেষ্টা করলেও যেন মন মানছে না। হার্টের রোগে মারা যাওয়া মানুষগুলোর দৃশ্য ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বার বার বলছে, ওমুকের এ হয়েছে। তমুকের ও হয়েছে। হায় আল্লাহরে তুমি আমার বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে একটা ভাল সংবাদ শোনাও।
কিছুক্ষণ জেনারেল ফিজিশিয়ান মহিলাটা রিপোর্ট হাতে এগিয়ে আসল। খুব গাম্ভীর্যতার সাথে বলতে লাগল, তোমার হাটের ইজিসি হার্টের ডাক্তার তাহিরকে দেখিয়েছি। রিপোর্ট এ্যবনরমাল।
– এখন কি করতে হবে? জানতে চাইলাম।
– অন্য হাসপাতালে যেতে হবে। আমাদের এখানে চিকিৎসা সম্ভব নয়।
– এখনি যেতে হবে? নাকি আগামীকাল?
– এ রিক্স আপনাদের। আমার পরামর্শ হল এখনি কোন বড় হাসপাতালে গেলে ভাল হবে, ডাক্তার সাফ জানিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নাজুকে বুঝিয়ে রাখার কিছুই বাকী রইলনা। ওর হতাশার মাত্রাটা বেড়ে গেল। সন্তান দুটি কথা ভেবে ওর দু চোখ বেড়ে পানি পড়ছে।
আমি ডাক্তার নই। তবুও ডাক্তারের কান্ডজ্ঞানহীন পরামর্শের নমুনা দেখে নিজেই বকাবকি করলাম।
বললাম,
– তোমার মনে আছে? দ্বিতীয় সন্তানের সময় তুমি কতো দোয়া করছিলে আল্লাহ আমাদের একটি কন্যা সন্তান দেয়ার জন্য। কিন্তু ডাক্তার বার বার ছেলে সন্তানের কথা নিশ্চিত করে বললেও অবশেষে কন্যা সন্তান তাসনিয়াকে পেয়ে বিশ্বাসই হচ্ছিলনা। কি আর করবো, অবশেষে ছেলে সন্তানের জন্য কেনা জামাই মেয়ে সন্তানকে পরিয়ে হাসপাতাল হতে বিদায় নিলাম।
প্রথমাবস্থায়, সিফা মেডিকেলের ডাক্তার আয়েশাতো আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে গিয়ে আশ্চার্য হয়ে বলতেই লাগল, বাচ্চা কৈ? বাচ্চাতো খুঁজে পাইনা। এ নিয়েও তুমি কেঁদেছিলে। কিন্তু অবশেষে সবই ভুল প্রমাণিত হল। আমার মনে হয়, এসব ডাক্তারগুলো মেডিকেলে পিছনের টেবিলের ছাত্র ছিল। খোঁজ নিয়ে হয়তবা দেখবে, মেডিক্যালের শিক্ষা বোর্ড এ সব আদুভাইদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্যই হয়তবা সাটিফিকেট দিয়ে বিদায় দিয়েছে…।
কোথায় যাবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। ভাবলাম আগে সন্তান দুটোকে বাসা থেকে গাড়ীতে তুলে নেই। বাসায় যেতে যেত বিল্ডিং এর ডাক্তার সাহাবুদ্দিনকে ফোন করলাম। বিষয়টা খুলে বলতেই জানাল, আজ আমার ডিউটি নেই। তবে হাসপাতালে এসেছি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য। ইচ্ছে করলে হাসপাতালে চলে আসুন। দেখি রিপোর্টে কি লিখা আছে।
ডাক্তার সাহাবুদ্দিন জেদ্দাস্থ কিং আব্দুল আজি ইউনিভার্সিটি মেডিকেলের আই,সি. ইউ. ডিপার্টমেন্টের ইনসেনটিভ কেয়ার এর ইনচার্জ ও স্পেশালিষ্ট। যে কোন বাংলাদেশীর সহযোগীতায় সে সবার অগ্রভাবে। তার কর্মদক্ষতা, ডাক্তারদের সাথে লিয়াজোসহ একজন সিনিয়র ডাক্তার হিসেবে সবার শ্রদ্ধাভাজন।
রাত ১১টা। সন্তানদের গাড়ীতে নিয়ে ছুটে চলেছি ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের দিকে। দুরত্ব বাসা হতে প্রায় ৭-৮ কিলো মিটার।
(চলবে)