আফরোজা হাসান
ভাইয়ার পাঁচ বছর বয়সি জমজ দুই পুত্রের চেহারা যেমন একদম আলাদা একে অন্যের থেকে স্বভাবেও দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন! নুবাঈদ চঞ্চল, ছটফটে, মেজাজি, এলোমেলো এবং খুবই দুষ্টু স্বভাবের! আর নুসাঈব শান্ত, চুপচাপ, গোছানো, কেয়ারিং এবং খুবই পাকা পাকা কথা বলা স্বভাবের! দুই ভাইয়ের পছন্দ-অপছন্দও আলাদা আলাদা! ভাইয়ার গাছপালা ভীষণ পছন্দ। এই স্বভাবটা নুসাঈব পেয়েছে। প্রকৃতির কোলে কোলে থাকলে খুব পছন্দ করে। নুবাঈদ এর উল্টো। সে বাগানে যায়ই গাছপালার শান্তি ভগ্ন করতে। দেখা যায় নুবাঈদ বাগানে খেলার সময় টান দিয়ে একটা ফুল বা গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলেছে। নুসাঈব ছুটে গিয়ে গাছে হাত বুলিয়ে আদর মেশানো কন্ঠে গাছের নাম ধরে বলবে, তুমি ব্যথা পেয়েছো? আহারে… তোমাকে আদর। নুবাঈদ ছোট মানুষ তো তাই বেশি বেশি দুষ্টুমি করে। তুমি রাগ করো না কেমন! আমি পাপাকে বলে দেব যেন নুবাঈদকে বকে দেয়। তোমাকেও যেন এসে সরি বলে। তুমি পানি খাবে? আচ্ছা তোমাকে পানি এসে দিচ্ছি। এই হচ্ছে আমাদের দুই সোনা পুটুলের অবস্থা!
একে সাথে হলেই দুই ভাই খুটখাট শুরু করে দেয়। আজ নুবাঈদ বসে ড্রইং করছিল। নীল রঙ শেষ হয়ে গেলে নুবাঈদ পাশে বসে থাকা নুসাঈবকে বলল, যাও তো রুম থেকে আমাকে নীল কালারের পেন্সিল এনে দাও। নুসাঈব নিজের ড্রইং নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই যেতে রাজী হলো না! নুবাঈদ তখন তেড়ে এলো নুসাঈবকে মারতে। ভাইকে তার দিকে তেড়ে আসতে দেখে নুসাইব ‘আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ বলে ফু দিতে শুরু করলো নুবাঈদের দিকে। নুবাঈদ চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি আমাকে ফু দিচ্ছো কেন? নুসাঈব বলল, শয়তান করায় বলেই মানুষ দুষ্টু কাজ করে। মারামারি অনেক দুষ্টু কাজ। তুমি আমাকে মারতে এসেছো কারণ এখন শয়তান তোমার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। পাপা বলেছে শয়তানের দুষ্টামি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। সেজন্য আমি ‘আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ বলে তোমাকে ফু দিয়ে দিচ্ছি। যাতে শয়তানের দুষ্টমি থেকে আল্লাহর তোমাকে সাহায্য করেন। তাকে শয়তান বলেছে ভেবে নুবাঈদ ঝাঁপিয়ে পড়লো নুসাঈবের উপর।
ভাইয়া ছুটে এসে দুই পুত্রকে আলাদা করলেন। নুবাঈদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, আমাকে শয়তান বলেছে। আমি শয়তান না। আমি ফেরেশতা। নুসাঈব প্রবল ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি তোমাকে শয়তান বলিনি তো। শয়তান তোমার ভিতরে ঢুকে তোমাকে দিয়ে দুষ্টূ কাজ করাতে চাচ্ছিলো। আমি তাই দোয়া পড়ে শয়তানকে তাড়িয়ে দিয়েছি। নুবাঈদ তখন কিছুটা শান্ত হলো। এক মূহুর্ত চুপ থেকে সেও ‘আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ বলে নুসাঈবকে ফু দিয়ে বলল, তুমি আমার কথা শোনোনি। আমাকে রঙ পেন্সিল এতে দাওনি। এটাও দুষ্টু কাজ। শয়তান তোমার মধ্যে ঢুকে ছিল বলে তুমি এই দুষ্টূ কাজটি করেছো। আমি ফু দিয়ে দিয়েছি এখন শয়তান চলে গেছে। যাও আমাকে নীল রঙের পেন্সিল এসে দাও। নুসাঈব এক মূহুর্ত দ্বীধা করলো এরপর রুমে গিয়ে রঙ পেন্সিল এসে দিলো নুবাঈদকে। ভাইয়া দুই পুত্রকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, মাশাআল্লাহ তোমরা দুইজনই আজ অন্নেক ভালো কাজ করেছো! এভাবে সবসময় নিজের সাথে সাথে একে অন্যের কাছ থেকেও দুষ্টু শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। পাপার মুখ দেখে প্রশংসা শুনে তো দুইজনই একদম গদগদ হয়ে গেলো।
দুই বাবা সোনার ঘটনাটি টাইম মেশিন হয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তিন বছর অতীতে। ইউরোপের এই বৈরী পরিবেশে শরীয়তের আলোকে সন্তানদেরকে গড়ে তুলতে চান এমন কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে একটি ফ্যামেলি প্রোগ্রাম করতাম আমরা নিয়মিত। বাচ্চাদের শরীয়তের আলোকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নানান ধরণের ইভেন্ট ছিল আমাদের সেই প্রোগ্রমে। ছোট বাচ্চাদেরকে গল্প আকারে কিংবা ছোট ছোট প্রশ্নাকারে শেখালে ওরা মজা যেমন পায় তেমনি শিখতেও পারে দ্রুত। আমরা এমন অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছিলাম ইসলামের মূল বিষয় সমূহকে ঘিরে। যেমন, তোমার সৃষ্টিকর্তা কে? পৃথিবীর সকল মানুষকে কে সৃষ্টি করেছেন? গাছ গাছালী এবং ফল ফলাদি কে সৃষ্টি করেছেন? সকল কাজ কোন দিক থেকে শুরু করতে হয়?যে কোন কাজ করা,যাওয়া,খাওয়া,পড়া,শোয়া, শুরু করতে হয় কি বলে?কেন সকল কাজের শুরুতে আমরা বিসমিল্লাহ বলবো? ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন প্রশ্নে প্রশ্নে ওদেরকে শয়তান সম্পর্কেও জানিয়েছিলাম। বুঝিয়ে বলেছিলাম শয়তান কিভাবে কুমন্ত্রণা দেয় মনে। কিভাবে মানুষকে দিয়ে দুষ্টু কাজ করায়! কিভাবে ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে! সাথে সাথে এটাও বুঝিয়ে বলেছিলাম আমরা, কেন ভালো কাজ করতে হবে, কেন দুষ্টু কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। নিজের সাথে সাথে অন্যদেরকেও ভালো কাজ করার পরামর্শ দিতে হবে, দুষ্টু কাজ করা থেকে বিরত করতে হবে।
শয়তান সম্পর্কে বাচ্চাদের সাথে প্রোগ্রাম করে আসার পর তো সব বোনদের বাসা থেকে ফোন আসতে শুরু করলো। কেউ বলল, আপু কি শেখালেন আমার ছেলে তো সারাদিন ফাইটিংয়ের উপরেই থাকে অদৃশ্য শয়তানের সাথে! আরেকজন বললেন, একটু পরপরই শুনি আমার মেয়ে বিড়বিড় করে ‘আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ পড়ছে। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়, শয়তান যাতে আমার কাছে আসতে না পারে তাই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছি। অবশ্য আমার নিজের ঘরের অবস্থাও একই রকম ছিল। নাকীব কখনো ছুটে এসে বলতো, আম্মুতা জানো একটু আগে কি হয়েছে? শয়তান এসে আমাকে খুবই দুষ্টু একটা কাজ করতে বলেছিল। আমি শয়তানকে ইচ্ছে মত মেরে গুড়াগুড়া করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি। আবারো কখনো ওর রুম থেকে প্রচন্ড ক্যারাটে প্র্যাকটিসের শব্দ ভেসে এলে কি হচ্ছে জানতে চাইলে জবাব দিতো, আম্মুতা শয়তানকে মারছি আমি। বাচ্চারা নতুন কিছু শিখলে প্রথম প্রথম যা হয় আরকি। তবে অন্য আর সব কিছুর চেয়ে এই ব্যাপারটায় খুব জোড়ালো প্রভাব ছিল বাচ্চাদের সবার মধ্যে। তারা অনেক সাবধান হয়ে গিয়েছিল দুষ্টুমির ব্যাপারে। টুকটাক মিথ্যা যা বলতো সেটার পরিমাণ আরো কমে গিয়েছিল। ভালো কাজের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল।
আবারো অনুভব করেছিলাম যে, বাচ্চারা আসলে অনেক নরম, কোমল ও পবিত্র মনের অধিকারী। ভালোর প্রতি, কল্যাণের প্রতি ওদের মানসিক ও আত্মিক টান সহজাত। ওরা সুন্দর থাকতে, সুন্দর দেখতে এবং সুন্দর কিছু করতে পছন্দ করে। ওদের মনের ভেতরটা আসলে বিশাল বড় সাদা এক ক্যানভাস। যে রঙয়ের আঁচড়ই সেই ক্যানভ্যাসে পড়ে ওরা মুগ্ধ হয়ে সেটাকে অবলোকন করে। তারপর পাশে পড়ে থাকা সেই রঙয়ের তুলিটাই তুলে নেয় নিজে কিছু আঁকার জন্য। তাই বাচ্চাদের সামনে কোন কিছুকে উপস্থাপন করার সময় সতর্কতার প্রয়োজন খুব খুব খুব বেশি। বিশেষ করে শরীয়তের বিধি-নিষেধ, জীবনের চলার পথের কল্যাণকর ও অকল্যাণ বিষয়সমূহ, ভালো কোনটা, মন্দ কোনটা ইত্যাদি সবকিছু খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে। এবং ছোটবেলা থেকেই নিজের সাথে সাথে অপরকেও ভালো কাজে উৎসাহিত ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারেও দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দিতে হবে। ছোটবেলাতেই যদি ভালো কিছু করার পথের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং মন্দ পথকে আকর্ষনীয় ও সহজ করে সামনে পেশ কারী শয়তান সম্পর্কে সাবধানতার অবলম্বন করতে এবং সেই ব্যাপারে প্রভুর কাছে সাহায্যে প্রার্থনা করার শিক্ষার বীজ বুনে দেয়া যায় শিশুদের মনে! এবং সেই বীজকে বিকশিত করার লক্ষ্যে পরিমিত যত্ন নেয়া হয়, আগাছা দূরীভূত করা হয়! তাহলে ইনশাআল্লাহ ভালো ও মন্দ সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নিয়ে শিশুরা বড় হতে এবং সেই অনুযায়ী জীবনকে পরিচালনা করতে শিখে যাবে ধীরে ধীরে!