banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1359 বার পঠিত

 

বুক রিভিউ – ‘সফলদের স্বপ্নগাথা’


মেহেদী আরিফ


বইয়ের নামঃ সফলদের স্বপ্নগাথা
সম্পাদকঃ ফিরোজ জামান চৌধুরী
ধরনঃ অনুপ্রেরণামূলক।
প্রকাশনীঃ অন্বেষা।
পৃষ্ঠাঃ ১৬০।
সফলতার নেপথ্যে নানা কথা থাকে, ঘটনা থাকে, থাকে নানা দুর্ঘটনাও। সফলতা এসে গেলে ভিতরের কথাগুলি বের হয়ে আসে, যেমনভাবে বের হয়ে আসে গর্ত থেকে সাপ। ফিরোজ জামান চৌধুরী সম্পাদিত “সফলদের স্বপ্নগাথা” একটি স্বপ্ন জাগানো বই, জেগে থাকার বই, সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার বই। প্রথিতযশা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, লেখক, রাষ্ট্রনায়ক, মানবাধিকার কর্মী, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও খেলোয়াড়দের জীবনের সফলতার বয়ান হল এই বইটি।
মাত্র বিশ বছর বয়সে ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম চালু করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেন বিস্ময়কর যুবক মার্ক জাকারবার্গ। হার্ভার্ডের পড়াশুনা না চুকিয়েই ফেসবুকে ডুব দেন এই তরুণ। তিনি একাডেমিক পড়াশুনা শিকেয় তুলে নেমে পড়েন ফেসবুক নামক ওয়েবসাইটের উন্নয়ন সাধনে। ঈর্ষণীয়ভাবে সফলতার প্রদীপ শিখার দেখা পান তিনি। বর্তমানে ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষ ফেসবুক চালান, নিজেদের মতামত শেয়ার করেন, পুরনো বন্ধুদের খুঁজে ফেরেন, বাইরের রাজ্যের সাথে ভিতরের রাজ্যের মেলবন্ধন ঘটান। এর নেপথ্যে জাকারবার্গ। ২০১১ সালে ফোর্বস সাময়িকী ঘোষিত ৩০-এর কম বয়সী সফল ব্যক্তিদের তালিকায় তিনি আছেন। জাকারবার্গ মনে করেন, কাজ করা ও শেখার সময়ে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার মাঝে শেখার মাত্রা বাড়ে। আর শেখার মাত্রা বাড়লে সফলতা তো হাতের মুঠোয় চলে আসে।
বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো অ্যাপল কম্পিউটারের স্রষ্টা স্টিভ জবস উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাতে কি! সফলতার দ্বারে তিনি ঠিকই ভিড়িয়েছিলেন তরী। এই মহারথী ব্যবহৃত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে পাঁচ সেন্ট করে উপার্জন করে খাবার কিনে খেতেন। বন্ধুদের কক্ষের মেঝেতে ঘুমাতেন। শুধু কি এখানেই শেষ? না, এখানে শেষ না। তিনি প্রতি রোববার রাতে সাত মাইল হেঁটে হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন একবেলা ভাল খাবারের আশায়। নিজের প্রতিষ্ঠিত অ্যাপল কোম্পানি থেকে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন। তাঁর সফলতার নেপথ্যে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনার মূল্যমান অনেক। স্টিভ জবস প্রত্যেক দিনকে মনে করতেন জীবনের শেষ দিন। এভাবে তিনি তাঁর কাজ সম্পাদন করেছেন। প্রতিদিন তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতেন আজ তিনি যা যা করছেন মরে যাওয়ার আগে কি তাই তাই তিনি করতেন?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিলগেটস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতে পারেন নি। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার ৩৩ বছর পর তিনি সেখানে ফিরে আসেন শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের সমাবর্তনের বক্তা হয়ে। জীবনের নানা চড়াইউতরাই পেরিয়ে সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছেন এই মানবতাবাদী। তিনি শিক্ষার্থীদের কর্মী হওয়ার জন্য আহবান করেছিলেন সমাবর্তনের বক্তৃতায়। সাথে সাথে বড় ধরনের বৈষম্য নিয়ে সবাইকে কাজ করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন।
ইন্টারনেটের জগতে সার্চ ইঞ্জিন গুগলকে কে না চেনে! ল্যারি পেইজ হলেন এই সার্চ ইঞ্জিনের উদ্ভাবক। তিনি মনে করেন, মূল রাস্তায় থেকে কাজ করার মাঝে সফলতা আসে। আরো মনে করেন, স্বপ্নের মাঝে বেঁচে থাকে কোনো মানুষকে আলাদা করার ক্ষমতা।
ইয়াহু’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং-এর সফলতার নেপথ্যে পরিশ্রমকে দাঁড় করিয়েছেন। ম্যালকম গডওয়েলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হলে ওই বিষয়ে অন্তত ১০ বছর অথবা ১০ হাজার ঘন্টা সময় দিতে হবে।’ ঘর থেকে বেরিয়ে বিশ্বকে দেখার উদাত্ত আহবান জেরি ইয়াং-এর। মনীষী অগাস্টিন বলেছেন, ‘পৃথিবী হলো একটা বিশাল বই, আর যারা পৃথিবী ঘুরে দেখেনি, তারা এই বইয়ের শুধু একটা পাতা পড়েছে।’ জেরি ইয়াং ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন , ‘জীবনের পথে যাদের পাশে পেয়েছ তাদের কখনো ভুলে যেও না।’
উইকিপিডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি স্যাঙ্গার অর্থপূর্ণ জীবনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন সারাজীবন মানুষের ভাবা উচিত তার প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য কি কি করা উচিত তা সম্পর্কে। সততার উপর বেঁচে থাকা কঠিন তারপরও তিনি সৎভাবে বেঁচে থাকার উপর জোর দেন। তিনি মনে করেন সৎভাবে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে মানুষ অর্থপূর্ণ জীবনে অভ্যস্ত হয়।
ডেল ইনকের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ডেল মনে করেন, সফলতার সবচেয়ে বড় নিয়ামক হল কৌতুহল। কৌতুহল মানুষকে চারপাশের মানুষকে জানতে, বুঝতে সহায়তা করে। জগৎটাকে বোঝার জন্য তিনি যেমন বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন, একইসাথে তিনি ওয়েবসাইট দেখতে বলেছেন, সাথে সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটাতে বলেছেন।
ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ মনে করেন যে, সফলতা পেতে মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে হবে, আকাঙ্ক্ষার শূন্য পূরণ করতে হবে। তিনি আরো মনে করেন যে, জীবনের নানাবিধ মোড় আমাদের সম্ভাবনা তৈরি করে ও এগিয়ে নিয়ে যায়।
পাঠক মাত্রই হ্যারি পটার সিরিজের নামের সাথে পরিচিত। সারা বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো হ্যারি পটার সিরিজের লেখক জে কে রাউলিংয়ের সফলতার পেছনে প্রধান কারণ হল তাঁর নিজেকে চেনার বিশাল ক্ষমতা। তাঁর কল্পনা করার ক্ষমতাও ছিল খুবই প্রখর যা তাকে হ্যারি পটার সিরিজ লেখার নেপথ্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
বর্তমান সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা লেখক চেতন ভগত মনে করেন, সফলতার জন্য সিরিয়াস হওয়া নয়, দরকার সিনসিয়ার হওয়ার। প্রথম বই প্রকাশের জন্য নয়জন প্রকাশকের কাছে গিয়ে তিনি না শুনেছিলেন। নয় জন প্রকাশকই তাঁর লেখাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবুও তিনি থেমে থাকেন নি। নিজের কাজ করে গেছেন খুব দৃঢ়তার সাথে। তিনি মনে করেন, আগে নিজেকে ভালবাসতে হয়, তারপর অন্যকে।
১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মার্কিন মহিলা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক টনি মরিসন মনে করেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অতীতের প্রয়োজন রয়েছে। বিপর্যস্ত বসুন্ধরাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য তিনি বিনীতভাবে অনুরোধ করেছেন। তিনি মনে করেন, আত্মতৃপ্তি মাঝেমাঝে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে তা যদি কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আসে তবে তাতে ক্ষতি নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, বক্তা ও সাংবাদিক ডেভিড শেংক মনে করেন, জিন, জ্ঞান-বুদ্ধি বা প্রতিভা নিয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তা ভুল। তিনি মনে করেন, সবার জিনেই আছে সুপ্ত প্রতিভা। সেই প্রতিভার স্ফূরণ ঘটানোর জন্য প্রয়োজন তীব্র ইচ্ছা, মনঃসংযোগ ও অবিরত অনুশীলন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে হয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। বেনজির মনে করতেন, যে সফল হয় এবং যে হেরে যায়, তাদের মধ্যে মূল পার্থক্যের জায়গা হল, কে তার সফলতা কিংবা বিফলতাকে কতটুকু গ্রহণ করতে পারে ও সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মনে করেন, জাতি, ধর্ম ও বর্ণের আঙ্গিকে কোন মানুষকে বিচার করা ঠিক না। সবাইকে সমান দেখার মাঝেই লুকিয়ে থাকে গণতন্ত্রের বীজ।
মিসাইল ম্যান নামে পরিচিত আধুনিক ভারতের রূপকার এ পি জে আবদুল কালাম স্বপ্ন, দৃঢ় সংকল্প, জ্ঞানচর্চা, কঠোর পরিশ্রম ও নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে জীবনের সফলতার সবচেয়ে বড় উপকরণ মনে করেন।
‘Change we need’ স্লোগানকে ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসেছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামা শিক্ষাকে রাষ্ট্র বা সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে সেরা নিয়ামক মনে করেন।
‘মাদিবা’ নামে পরিচিত বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা উদ্ভাবনের দিকে নজর দেয়ার জন্য তরুণদেরকে আহবান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন দরিদ্রতাকে জয়লাভ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তারপর জয় করা অশিক্ষা ও অজ্ঞানতা।
এ বইটিতে অংসান সুচি, শিরিন এবাদি, কফি আনান, বান কি মুন, আল গোর, প্রিন্সেস ডায়ানা, শাকিরা, মাইকেল জ্যাকসন, বন জোভি, ড্যানিয়েল রাডক্লিফ, টম হ্যাঙ্কস, শোয়ার্জনেগার, জেমস ক্যামেরন, অমিতাভ বচ্চন, রোয়ান সেবাস্টাইন অ্যাটকিনসন ( মি. বিন), বিশ্বনাথন আনন্দ, ব্রায়ান লারা ও শচীন টেন্ডুলকরের জীবনের সাফল্যগাথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বইটি তরুণদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার এক চমৎকার উৎস।।

Facebook Comments