banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 759 বার পঠিত

 

বিয়ে বিচ্ছেদে অনিশ্চিত সন্তানের ভবিষ্যৎ


রহিমা আক্তার মৌ


বিয়ে বিচ্ছেদ একজন নারীর জীবনে নিয়ে আসে নানা সমস্যা। কিন্তু তার চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে এসব পরিবারের সন্তানেরা। তারপরও আমাদের দেশে বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে। যা আমাদের শঙ্কিত করে।
এসব নিয়ে লিখেছেন রহিমা আক্তার মৌ

প্রিতুলার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে বেশ আগেই। প্রিতুলার বাবা সন্তানদের কোনো খোঁজ নেন না, যোগাযোগ বা কোনো খরচও দেন না। প্রিতুলারা দুই বোন মায়ের কাছেই থাকে। মায়ের সামনে কখনোই বাবা শব্দটাও উচ্চারণ করে না প্রিতুলা। ওয়াশরুমে গান গায় প্রিতুলা- ‘আমি যাচ্ছি বাবা… আমি যাচ্ছি।’
বের হওয়ার পর ওর মা জিজ্ঞেস করে-
কি গান করছিলে মা।

‘আমি যাচ্ছি মা… আমি যাচ্ছি।’
মা আবার জিজ্ঞেস করলেই প্রিতুলা সত্যিটা বলে, আর বলে- ‘মা গানটা তো বাবা দিয়েই, তাই ওভাবে গাইলাম।’

ঠিক একই ঘটনা এলিজারও। এলিজার বাবা-মায়ের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এলিজা মায়ের সাথে থাকে। বাবা মাসে এক হাজার টাকা করে দেয় ওর খরচ। ১৪-১৫ বছর বয়সী একটা সন্তানের মাসের খরচ এক হাজার, সত্যিই মনে হচ্ছে- আট টাকায় এখন এক মণ চাল পাওয়া যায়।

এ সন্তানদের অবস্থা অনেক ভালো বলা চলে। প্রিতুলা বা এলিজার মা আর বিয়ে করেননি। সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রেখে কাটিয়ে দিচ্ছেন নিজের বাকি জীবন। দিন তো ঠিক যাচ্ছে, অবচেতনে প্রিতুলা বাবার গান গাইছে, এলিজা মন দিয়ে বন্ধুদের কাছে বাবার গল্প শুনছে, ওদের দিন কাটছে। এর চেয়ে অনেক কঠিন কিছু ঘটনার সম্মুখীন আমরা। সন্তান নিয়ে মা আবার বিয়ে করলে মায়ের সে স্বামী কিন্তু কখনোই সন্তানের বাবা হয় না, হতে পারে না। সে সন্তান যদি মেয়ে সন্তান হয়, তাহলে মায়ের পরের স্বামী কিন্তু সেই মেয়ের জন্য পর পুরুষ। (ব্যতিক্রম কিছু আছে) এই পরপুরুষ দ্বারা মেয়ে সন্তানের জীবন অতিষ্ঠ হওয়ার কিছু ঘটনাও সকলের জানা। তাই আমাদের ভাবতে হবে সন্তানদের কথা, সন্তানদের ভালো আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটু ত্যাগের বিনিময়ে হলেও সমঝোতায় আসা উচিত বাবা-মায়ের। বিয়ে বিচ্ছেদে নিজের সুখ আসতে পারে, কিন্তু সন্তানের নয়। বিষয়টা দাঁড়াল বাবা-মা নতুন করে জীবন সাজাতে গিয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন নিজের সন্তানকে। এ ঘটনার জন্য একা মা বা বাবা দায়ী নন, দায়ী দুজনেই।

ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রতিটা দম্পতির উচিত বিয়ের পর অন্তত দুই-চার বছর অপেক্ষা করে সন্তান নেয়া, নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস-বন্ধন অটুট হলে বা দুজন দুজনকে বুঝলে তারপর সংসারে নতুন অতিথির কথা ভাবা। বিষয় হলো এখন অনেক মেয়ের বিয়ে হয় লেখাপড়া শেষ করে, তখন তাদের বয়স পঁচিশের ঊর্ধ্বে হয়ে যায়। ডাক্তারদের মতে অনেক ক্ষেত্রে ত্রিশের ঊর্ধ্বে মেয়েদের সন্তান হওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়, তাই বিয়ের পর সন্তান নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। ‘ঢাকা শহরে দিনে ৫০-৬০টি দম্পতির বিচ্ছেদের আবেদন করে।’ এমন একটি তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরে আতঙ্ক দেখা দেয় সচেতন মহলে। বিয়ে বিচ্ছেদ এখন আমাদের সমাজের একটা বিষফোঁড়া, আর বিষফোঁড়ার বিষাক্ত জীবাণু আক্রমণ করছে আমাদের পরের প্রজন্মকে, অর্থাৎ বিয়ে বিচ্ছেদের পরিবারের সন্তানদের।

নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ ও নারী নেতৃত্ব বেড়েছে। সাথে বাড়ছে চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা। সে হারে পরিবর্তন হয়নি পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশের অবস্থা। বাইরের কাজ করে ঘরের সব দায়িত্ব পালন করেও নারীকে শুনতে হচ্ছে অনেক কথা। দু’দিকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একপর্যায়ে নারীরা হাঁপিয়ে উঠছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। অল্প শিক্ষিত দম্পতিদের চেয়ে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে বেশি। এ জন্য অনেকে শিক্ষিত নারীর জীবিকাকে দোষারোপ করছেন, কিন্তু এর পেছনের গল্প অনেকেই খুঁজতে চান না।

একজন চাকরিজীবী পুরুষ বাইরে বেশী সময় দিলে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু একজন চাকরিজীবী নারী চাকরির প্রয়োজনেই বাইরে বেশী সময় দিলে, এই নিয়ে শুরু হয় অশান্তি এবং এর পরিণাম বিয়ে বিচ্ছেদ। এ বিচ্ছেদের ফলে তারা নতুন জীবন বেছে নিলেই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মতের অমিল, সমঝোতার অভাব, শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি, পুরুষের আধিপত্য ও পরকীয়ার কারণেই বেশি বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে। তবে শারীরিক দুর্বলতা, প্রত্যাশা পূরণের অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনধিকার চর্চা, ধৈর্যের অভাব এবং ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা হওয়ার ফলেও বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে অনেক।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। অনেকের মতে, বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ার ফলে স্ত্রীর মৃত্যুর হার কমেছে বললেও পক্ষান্তরে নারী নির্যাতন আর মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের সংখ্যা বেড়েছে। সমস্যার বোঝাপড়া না করতে পেরে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে এক সময় কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় তারা। কারণ একটা শিশুকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে একা মা কিংবা বাবার দ্বারা সম্ভব নয়, সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবা-মা দুজনের প্রয়োজন।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় বায়ান্ন হাজার। হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬টি, দিনে ২৪টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। বিচ্ছেদের যেসব আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে পরকীয়ার জেরে। কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর পরকীয়া, কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীর পরকীয়া হলেও তথ্য বলছে বিয়ে বিচ্ছেদে নারীরা এগিয়ে আছে। জরিপে দেখা গেছে, ৭০.৮৫ শতাংশ বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন নারী, আর ২৯.১৫ শতাংশ বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন পুরুষ।

নারীদের হার বেশি হওয়ার পেছনে মনোবিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, সাধারণত নারীরা বেশি নির্যাতিত হওয়ায় তারাই বিচ্ছেদের পদক্ষেপ বেশি নিচ্ছে; তবে এর সাথে ভিন্ন মতামত ও রয়েছে। অনেকে বলেন, মেয়েরা এখন অধিকার সচেতন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই বেশি অধিকার পেয়ে বিয়ে বিচ্ছেদে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। মূলত বিয়ে বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’। স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সাথে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর স্বামীদের আবেদনের কারণ- অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা এবং সন্তান না হওয়াসহ এমন অনেক কারণ।

আমরা যতই নারী উন্নয়নের কথা বলি না কেন, এখনো বেশির ভাগ নারীরা গৃহকাজে রয়েছেন। এখনো অধিক হারে নারী নির্যাতন হচ্ছে। একজন পুরুষ ঘরে থাকেন কতক্ষণ, তিনি সংসারের অনেক ঝামেলাকে আড়াল করতে পারেন বাইরে গিয়ে কাজের মধ্যে, আর নারী অবহেলা নির্যাতন সব সয়ে সংসারেই প্রতিটি সময় কাটিয়ে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেন। নিজেকে দুর্বল ভাবতে থাকেন, একপর্যায়ে কাউন্সিলিংয়ের অভাবে তিনি বিয়ে বিচ্ছেদের মতো কাজ করতে বারবার ভাবেন না। আরো একটা বিশেষ কারণ হলো- দুর্বলতার সুযোগ।

একজন নারী যখন পরিবারেই অবহেলিত হন তখন বাইরের একটু ভালো কথা, ভালো লাগা-ভালোবাসা পেলে সে নিজের বোধবুদ্ধি ত্যাগ করে বাইরের ক্ষণিকের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে ঘর সংসার ভুলে পরকীয়ায় মেতে ওঠে। বাধ্য হয়ে শুরু হয় অশান্তি, যার ফল দাঁড়ায় বিয়ে বিচ্ছেদে। বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যে- গত বছর ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি এক হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১.৫ (এক দশমিক পাঁচ)। তথ্যে আরো বলা হয়- তুলনামূলকভাবে বর্তমানে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে, যা ২.৭ (দুই দশমিক সাত)। আর সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে .৬ (দশমিক ছয়)। এটিও ঠিক, নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ফলে নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হচ্ছে, তাই বলে বিচ্ছেদে গিয়ে সন্তানদের টানাপড়েনে ফেলে নয়। বিয়ে বিচ্ছেদ সন্তানদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাবা-মায়ের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ হলে সন্তানেরা অস্থিরতার মধ্যে বড় হয়, যার প্রভাব বইতে হয় সারাজীবন।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রবণতা হলো নারীরা সহজে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন না। বাংলাদেশে নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন কেন বাড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের মতামত ছাড়া কম বয়সেই বিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে- বেশি বয়সী লোকের সাথেও অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। একটাপর্যায়ে গিয়ে এ ধরনের বিয়েগুলো টিকছে না। সন্তানরা চায়, মা-বাবার সাথে একসাথে একটি স্বাভাবিক ও সুখী পরিবার হয়ে থাকতে। বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা নতুন কিছু নয়, আবার কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও হয়তো নয়। কিন্তু সন্তান থাকলে তার বা তাদের ওপর এর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাও অস্বীকার করার মতো না। আবার সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকেও তো বিচ্ছেদর বিষয়টি দেখা দরকার। সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়ার অধিকার মা-বাবা কারোই নেই। তাই আবারো বলছি, সন্তান জন্মের আগেই ভাবতে হবে কয়েকবার, একটি সন্তানকে পৃথিবীতে এনে আলোর মুখ দেখাতে যেমন বাবা-মা দুজনের প্রয়োজন, তেমনি ওই সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে এই দুজনকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

সুত্র: নয়াদিগন্ত।

Facebook Comments