কানিজ ফাতিমা
মেনোপজে যে মানসিক সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয় তা নারীর কর্মক্ষমতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে নারীর পরিবারের সদস্যরা ও সহকর্মীরা তার আচরণে আহত ও বিরক্ত বোধ করতে পারে।
গতপর্বে বলেছিলাম এ সময়ের প্রধান তিনটি মানসিক সমস্যা হলঃ
দুঃখবোধ বা বিষন্ন হওয়া, অস্থিরচিত্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া। এ পর্বে থাকবে এ নিয়ে আরও কিছু আলোচনা।
সব মহিলা তার জীবনের এই পরিবর্তিত অবস্থাকে সমানভাবে মেনে নিতে পারেনা। যারা আগে থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে এবং পরিবার থেকে সহযোগিতা ও নিশ্চয়তা পায় তারা অন্যদের তুলনায় এই পরিস্থিতি অধিক সহজভাবে মোকাবিলা করে। যেমন কোন মহিলা যদি মনে করে যে, সে তার নারীত্ব হারিয়ে ফেলছে ফলে সে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে, তবে তার মানসিক সমস্যা অন্যদের থেকে বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে। যদি সে আশঙ্কা করে যে তার স্বামী আর একটি বিয়ের দিকে আগাতে পারে তবে সে আরও বেশি বিচলিত হতে পারে। এমতাবস্থায় সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও নিজেকে মূল্যবান প্রমাণের জন্য সে স্বামী, পুত্র-কন্যা ও পুত্রবধুর সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। যদি এমনটা হয় তবে পরিবারের অন্যদের দায়িত্ব হল তাকে নিশ্চয়তা দান করা ও তার সঙ্গে এমন আচরণ করা যাতে সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে সে মূল্যহীন হয়ে যায়নি। এ সময় মা তার পুত্রের উপর অধিক নিয়ন্ত্রণ চাইতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবেই পুত্রবধুকে তার প্রতিদ্বন্দী মনে করতে পারে। এক্ষেত্রে পুত্রকে সচেতনতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। একদিকে মা আঘাত পায় এমন কাজ থেকে যেমন তাকে বিরত থাকতে হয় আবার অন্যদিকে মায়ের অযাচিত আবদারকেও সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এ সময় মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য তাকে (মাকে)মেনপজের ওপর বই, আর্টিকেল পড়তে দেয়া যেতে পারে ।
কর্মজীবী মহিলা, যারা তার চাকুরী ও আয় নিয়ে সন্তুষ্ট, তাদের ওপর মেনোপজের প্রভাব তুলনামূলকভাবে গৃহিনী ও যারা কোন প্রকার সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নয় সেসব নারীদের থেকে সাধারণত কম হয়ে থাকে। ফলে এ সময় তাকে সমাজসেবামূলক কোন কাজে উৎসাহী করা যেতে পারে; বাগান করা বা বাড়ীর অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও তাকে দেয়া যেতে পারে। এতে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা শুরু করবে এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। ফলে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার অস্বাভাবিক পন্থাগুলো থেকে নিজে থেকেই সরে আসবে।
মেনোপজ নারীদেহের বার্ধক্যের নির্দেশক। শৈশব থেকে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করার সব ক’টি বয়সের ধাপকেই মানুষ স্বাগত জানায়। কিন্তু যৌবনের পরে বার্ধক্য আসাকে মানুষ কখনওই স্বাগত জানায় না। ফলে অধিকাংশ নারীই এ সময়ে জীবনের মানে হারিয়ে ফেলে। সে তার যৌবন ও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলার শোকে ভোগে। ফলে কখনও সে অসহায় বোধ করে এবং পরমুহূর্তে রাগ অনুভব করে। একারণে সে খেয়ালী ও জেদী আচরণ করে। তাছাড়া মেনোপজে যে শারীরিক সমস্যার তৈরি হয় সেগুলো অনেক সময় নিদ্রাহীনতার জন্ম দেয় এবং নিদ্রাহীনতা থেকে মেজাজ খারাপ ও খিটখিটে ভাবের জন্ম হয়।
মেনোপজের সঙ্গে যে মানসিক অবস্থাগুলো যুক্ত তার বিস্তারিত একটি তালিকা নীচে দেয়া হল-
0 Less energy and drive (শক্তি ও উদ্যম কমে যাওয়া)
0 Irritability (বিরক্তি ভাব)
0 Mood changes (মেজাজের ভারসাম্যহীনতা)
0 Headaches (মাথাব্যথা)
0 Feeling of unworthiness (নিজেকে মূল্যহীন মনে করা)
0 Loss of self-esteem (আত্মসম্মানবোধের অভাব)
0 Loss of self-confidence (আত্মবিশ্বাসের অভাব)
0 Feeling unable to cope (খাপ খাওয়াতে না পারা)
0 Difficulty in concentrating (মনোযোগ দিতে না পারা)
0 Feelings of aggressiveness (ঝগড়াটে বা আক্রমণাত্মক হওয়া)
0 Depression (হতাশ বোধ)
0 Anxiety (দুশ্চিন্তা বোধ)
0 Forgetfulness (ভুলোমনা)
0 Fear of loneliness (একাকীত্বের ভয়)
0 Unusually prove to tears (কারণে অকারণে কান্না পাওয়া)
0 Tired (ক্লান্তিবোধ)
মেনোপজের এই লক্ষণগুলো কার ক্ষেত্রে কতটুকু হবে তার অনেকখানি নির্ভর করে দেশীয় সংস্কৃতি ও পারিবারিক সংস্কৃতির উপর। সাধারণত যেসব দেশে নারীরা নিজেদেরকে অভিজ্ঞতার আসনে দেখতে পছন্দ করে ও সৌন্দর্য সম্পর্কে অত্যধিক সচেতন না, সেসব দেশের নারীরা মেনোপজে কম মানসিক সমস্যা বোধ করে। উপরন্তু অনেক সময়ই বার্ধক্যকে তারা অধিক সম্মান ও যত্ন পাবার সুযোগ হিসাবে মনে করে। তাছাড়া যেসব দেশে সন্তানরা বাবা-মা’র কাছাকাছি থাকে (Collective Society) সেসব দেশেও মেনোপজের সমস্যা নারীরা তুলনামূলকভাবে কম অনুভব করে। অপরপক্ষে, Individualistic Society- যেখানে নারীরা শরীর ও সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রচণ্ড সচেতন এবং যারা সন্তান সন্তুতির থেকে দূরত্ব বজায় রাখে তাদের মধ্যে মেনোপজের সমস্যা তুলনামূলক বেশি হয়। একারণে গবেষণায় দেখা গেছে জাপানের নারীরা পশ্চিমা নারীদের তুলনায় এ সম্পর্কিত সমস্যায় কম ভোগে।
এ থেকে সহজেই বোঝা যায় সচেতনতার সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারটি মোকাবিলা করলে বা সামলে নিলে নারীদের জন্য মেনোপজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া সহজ হয় এবং এ কারণে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তিগুলো সহজেই কমিয়ে আনা যায়।