কানিজ ফাতিমা
গত দু’টি পর্বে মাসিককালীন ও এর পূর্বে নারীর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছি। এ পর্বে আলোচনা করবো গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর মানসিক অবস্থা নিয়ে।
মূলতঃ গর্ভকালীন সময়ে নারীর শারীরিক পরিবর্তন ও কষ্টগুলো সম্পর্কে কমবেশী আমরা সবাই অবগত। কিন্তু এ সময়ে নারীকে যে বিরাট মানসিক পরিবর্তন ও চাপ সহ্য করতে হয় সে ব্যাপারে বেশীরভাগ মানুষই সচেতন নন। এ সময়টি মূলতঃ স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্যই একটি সংকট মুহূর্ত। একদিকে সুখ ও আশা অন্যদিকে নানা রকম ভয় ও শঙ্কা এ সময়টিকে উভয়ের জন্য কঠিন করে তোলে। বিশেষ করে একজন নারী এ অবস্থায় প্রতিটা মুহূর্তে নানা রকম চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে। ফলে তার জন্য আশেপাশের মানুষগুলো বিশেষ করে স্বামীর সার্বক্ষনিক সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। সব থেকে বেশী দরকার স্বামীর পক্ষ থেকে তাকে আশা ও নির্ভরতার গ্যারান্টি দেয়া। আমি অবাক হয়েছি এটা জেনে যে, এ সময় অনেক পুরুষ স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন এই ভয়ে যে তার আশেপাশের লোকজন বা আত্মীয়রা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে বা বলবে “ কেমন পুরুষ মানুষ, বউয়ের সেবা করে…”। আমি এটাও শুনেছি গর্ভকালীন শারীরিক কষ্ট বিশেষ করে সকাল বেলার দুর্বলতা (Morning Sickness) এর কারণে গর্ভবতী বিছানায় শুয়ে থাকলে তাকে অনেক সময় শাশুড়ী- ননদরা বলেন, “ দেখে মনে হয় তোমার একলারই বাচ্চা হবে। ছেলে-পুলে তো আমাদেরও হয়েছে…”। এ সকল পরিস্থিতিতে স্বামীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর মনে রাখতে হবে যে, স্ত্রীর সেবা করায় দোষের কিছু নেই। এটা কোন দুর্বলতার লক্ষণ না, বরং ‘পাছে লোকে কিছু বলে’- এই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে পারা সবল মানসিকতা সম্পন্নদের পক্ষেই সম্ভব।
তাছাড়া হাদিসেও এর পক্ষে সবল দৃষ্টান্ত রয়েছে ৷ বদর যুদ্ধের সময় সংখ্যায় মুসলমানরা কম ছিলেন ৷ সেসময় মদীনাতে মাত্র ৭৭ জন সমর্থ মোহাজির পুরুষ ছিলেন ৷ তিনজন বাদে এদের সবাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ৷ তালহা ও সা’দ (রা:) সেই মুহুর্তে সংবাদ সংগ্রহের কাজে মদীনার বাহিরে ছিলেন বলে বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি ৷ আর তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মদীনাতে উপস্থিত থেকেও বাহিনীতে যোগ দেননি তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সারির সাহাবী উসমান (রা:) ৷ যদিও সে সময় মুসলিম বাহিনীতে বেশী সংখ্যক যোদ্ধার দরকার ছিল তথাপি রাসুল (সা:) নিজেই উসমান (রা:) কে মদীনায় থাকতে নির্দেশ দেন কারণ সেই সময় তার স্ত্রী রোকাইয়া (রাসুল সা: এর কন্যা) অসুস্থ ছিলেন ৷ ” the Prophet had told his son-in-law ‘Uthman’ to stay at home and tend his sick wife” ( MUHAMMAD –his life based on the earliest sources by Martin Lings, পৃষ্ঠা: ১৩৮ ) আমরা এখানে স্পষ্ট দেখতে পাই শুধুমাত্র অসুস্থ স্ত্রীর দেখাশোনার জন্য তিনি বদর যুদ্ধের বাহিনীতে যোগদান থেকে বিরত থাকলেন স্বয়ং রাসুল (সা:) এর নির্দেশে ৷ অথচ সে সময় মদীনাতে অন্যান্য নারীগণ উপস্থিত ছিলেন যারা সহজেই তার সেবা করতে পারতেন ৷ সাওদা (রা:) ( রাসুল সা: এর স্ত্রী); ফাতেমা রা: ও উম্মে কুলসুম রা: (রোকাইয়ার দু’ বোন); উম্মে আয়মান ও খাওলা সহ অনেকেই রোকাইয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ৷ তদুপরী রাসুল (সা:) স্ত্রীর সেবার জন্য স্বামীকেই দ্বায়িত্ব দিলেন। আমরা সবাই জানি গর্ভকালীন সময়ে যে সমস্যাগুলো হয় তা একেক জনের একেক মাত্রায় হয়। বিশেষ করে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় একদিকে তার ভীতির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, অন্যদিকে সমস্যাগুলো মোকাবেলার পদ্ধতিগুলো অজানা থাকে। ফলে এ পরিস্থিতিটি তার কাছে কঠিন থেকে কঠিনতর আকার ধারণ করে। এজন্য স্বামী ও স্ত্রীর উভয়েরই যদি আগে থেকেই এই সময়কার নারীর শরীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো জানা থাকে তবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
যেহেতু গর্ভকালীন সময়ে নারীর শারীরিক কষ্ট ও পরিবর্তনগুলো চিকিৎসক দ্বারা নির্ণিত হয় সেহেতু আমি ঐদিকে না গিয়ে, নারীর মানসিক অবস্থা ও পরিবর্তন, যা অনেক সময়ই আলোচনার বা নজরের বাইরে থাকে, সেদিকে আলোকপাত করবো। তবে আগে বলে রাখা ভালো যে কোন কোন নারীর ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাগুলো মারাত্মক হতে পারে। সে অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। আমি কেবল মাত্র সাধারণ পরিবর্তনগুলো (Common changes) নিয়ে আলোচনা করবো। গর্ভকালীন পুরো সময়টাকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি।
১. First Trimester : ১ম সপ্তাহ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ১ম একতৃতীয়াংশ বা First Trimester ধরা হয়।
২. Second Trimester : ১৩তম সপ্তাহ থেকে ২৭তম সপ্তাহ পর্যন্ত দ্বিতীয় একতৃতীয়াংশ বা Second Trimester: ধরা হয়।
৩. Third Trimester : ২৮তম সপ্তাহ থেকে ৪২তম সপ্তাহ পর্যন্ত তৃতীয় একতৃতীয়াংশ বা Third Trimester ধরা হয়।
অনেকে কিভাবে সপ্তাহ গণনা করতে হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। সর্বশেষ মাসিক যেদিন শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই সপ্তাহ গণনা শুরু হয় (মাসিক শেষের দিন নয়)।
যদিও গর্ভকালীন সময়ের পরিবর্তনগুলো কমবেশী একই রকম তবুও প্রত্যেকটি কেসই কোন না কোন দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। শরীরের আকারের পরিবর্তন, হরমোনের পরিবর্তন, Culture বা সাংস্কৃতিক অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ধরন, মানসিক প্রস্তুতি এসব কিছুর সংমিশ্রনেই গর্ভকালীন অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। যেমন ধরুন কোন স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তান আশা করে এবং সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে তবে গর্ভধারনের সংবাদ দু’জনই আনন্দের সঙ্গে নিবে। অন্যদিকে তারা যে সময়ে এটা চাচ্ছিল না তখন যদি এ সংবাদ পায় তবে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। তারা আনন্দ ও দুঃশ্চিন্তা এ দু’য়ের মাঝামাঝি দুলতে থাকবে।
ভাবী মায়ের মানসিক অবস্থা তার শারীরিক অবস্থা ও সন্তানের বিকাশে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যা পরিণামে পরিবারের অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। যেমন কোন গর্ভবতী যদি মানসিক চাপে ভোগে তবে তার বমিভাব ও দুর্বলতা বেশী হবার সম্ভাবনা থাকে। তার এই শারীরিক কষ্ট তার মানসিক চাপকে বাড়িয়ে দেবে। ফলে সে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে বিশেষ করে স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হবে না। যা পরিণামে তার মানসিক চাপ আরও বাড়াবে। এভাবে প্রক্রিয়াটি চক্রের আকারে চলতে থাকবে।
এবার দেখা যাক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় Trimester এ গর্ভবতীর অবস্থা কেমন হয়:
First Trimester : যে মুহূর্তে একজন নারী জানতে পারে যে সে মা হতে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই তার চিন্তা ও অনুভূতিতে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এ সময় অনেকেরই Emotional Swing খুব দ্রুত ঘটতে তাকে। খুব অল্পতেই তারা হতাশ অনুভব করে, রাগান্বিত হয় বা আনন্দিত হয়। সব নারীরই কম বেশী Emotional Swing হয় তবে তার পরিণাম নির্ভর করে নারীর Personality Type (ব্যক্তিত্বের ধরন) এর উপর। অনেক সহিষ্ণু ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীকেও এ সময় অল্পতেই কান্না-কাটি করতে দেখা যেতে পারে। স্বামী ও পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এ অবস্থাকে মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করে।
এই সময়ই গর্ভপাতের আশংকা থাকে। ফলে এই ভয় বা অনিশ্চয়তা নারীর উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে, অনেককে দেখা যায় যে তারা হাঁটতেও ভয় পায়। বিশেষ করে Miscarriage এর পূর্ব অভিজ্ঞতা যাদের থাকে তাদের উপর এ চাপের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে অনেকেক্ষেত্রে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনেও ভয় পেতে পারে। এই দুশ্চিন্তা ও চাপের মাত্রা আরও বেড়ে যায় যদি ঐ নারীর মনে হয় যে গর্ভপাত হলে স্বামী বা শশুর বাড়ীর লোকজন তাকেই এর জন্য দায়ী করবে। এ পরিস্থিতিতে স্বামীর পক্ষ থেকে মানসিক সান্ত্বনা নারীর একান্ত প্রয়োজন। সফল গর্ভধারণ বা গর্ভপাত যাই ঘটুক নারী তার স্বামীর সহমর্মিতা থেকে বঞ্চিত হবে না- স্বামীকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। এই নিশ্চয়তা নারীকে সংকট কাটিয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করে।
এক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। এ সময় স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলনেও অনেক স্ত্রী ভয় পায়। এবং মিলনের পরের দু’এক দিনের মধ্যে যদি গর্ভপাত ঘটে তবে স্ত্রীর মনে স্বামীকে দায়ী করার প্রবণতা তৈরি হয়। স্ত্রীদের জানা থাকা দরকার এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অন্যদিকে স্বামীর জানা প্রয়োজন স্ত্রী গর্ভজনিত মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। কাজেই স্ত্রীকে কোন কিছুতে বাধ্য করা বা বাড়তি চাপ প্রয়োগ করা ঠিক নয়।