বলিউডের ব্যতিক্রমী অভিনেত্রী কারিনা কাপুর খান কয়েকদিন আগে একটি ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করে হইচই ফেলে দিলেন মিডিয়াতে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিশেষ পোশাকের মুখপাত্র হওয়ার পর ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চ মাতালেন কারিনা। ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচীর পোশাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় র্যাম্পে হাঁটলেন তিনি।
এই প্রথমবার ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জীর কোনও ক্রিয়েশন পরেন কারিনা। এর আগে তারকা ডিজাইনারের সঙ্গে কোনও শো বা ছবিতে কাজ করা হয়নি বলে আক্ষেপও ছিল কারিনার। সে আক্ষেপও ঘুচল এই শোয়ে। ৩৪ বছর বয়সী অভিনেত্রী ক্যাটওয়াকের সময় বলেন, এই শো চিরকাল তার কাছে খুব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। কারণ তার সন্তানও এখানে হাঁটলেন তার সঙ্গে। সবদিক দিয়েই এই শো নিয়ে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। এর সঙ্গে তিনি জানান, তার শাশুড়ি শর্মিলা ঠাকুর ডিজাইনার সব্যসাচীর কাজের বড় ভক্ত।
সব্যসাচী মুখার্জীর সাক্ষাৎকার পাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। পারফেকশনিস্ট ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে বেশ নাম ডাক আছে সব্যসাচী মুখার্জীর। তাই শোয়ের আগে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন খুঁটিনাটি নিয়ে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও চল্লিশোর্ধ্ব ডিজাইনার ভারতীয় একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য সব্যসাচী মুখার্জীর সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হল-
আপনি ‘ল্যাকমে’র ফ্যাশন ডিজাইনার আগেও বহুবার হয়েছেন। এখনও শো’য়ের আগে নার্ভাস লাগে আপনার?
সব্যসাচী মুখার্জী: নাহ্! অনেক তো বয়স হল। এখন আর নার্ভাস লাগে না। আসলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হতাশ হওয়াগুলোও কমে যায়। সত্যি কথা বলতে কী, একটা সিজন একটু গড়বড় হলেও আমার ব্যবসার কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু নতুনদের জন্য একটা শো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কম বয়সে অনেক বেশি নার্ভাস থাকতাম। শো করতে হলে ভয় পেতাম। এখন সেসব হয় না। আরেকটা কথা ঠিক, যে সংবাদমাধ্যমকে খুশি করার জন্যে আমাদের অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে বুঝেছি, নিজস্ব ছাপ ধরে রাখতে পারলে তবেই ক্রেতারা খুশি হবেন। আর ক্রেতারা খুশি হলে সংবাদমাধ্যমের কাছে আলাদা করে কিছু প্রমাণ করতে হবে না। হয়তো আমার কথাগুলো খুবই একগুঁয়েমির মত শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি বাস্তবতা বিশ্বাস করি।
ফ্যাশন দুনিয়ায় একটার পর একটা সিজন কি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ?
সব্যসাচী মুখার্জী: গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো সারা দুনিয়ার দৃষ্টিতে দেখলে কিছুটা গুরুত্ব পায়। কারণ এখনও কিছু জায়গায় একেক রকম আবহাওয়ায় অনেকটা পার্থক্য দেখা যায়। অবশ্য এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য সকলেই একটা মাঝামাঝি মৌসুম ধরে নেয় ফ্যাশনের ক্ষেত্রে। কিন্তু ভারতীয় আবহাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সারা বছরে একটা ফ্যাশন উইক করলেই আমার জন্যে যথেষ্ট।
এবারের ফিনালের কালেকশনের পিছনে কোনও অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?
সব্যসাচী মুখার্জী: ল্যাকমে’র ফিনালে করলে কী হয়, প্রথমে মেকআপটা কেমন হবে, সেটা বলে দেওয়া হয়। তার উপর নির্ভর করে, কালেকশন কী হবে। এবারের থিম ছিল ‘শিমার’। শিমার দু’ভাবে করা যায়। এক, ম্যাট রঙের পোশাকের সঙ্গে। আর দুই, শিমারি পোশাকের সঙ্গে। আমার কালেকশনে এই দু’রকমই চোখে পড়বে। কালার প্যালেট ঠিক করেছি ল্যাকমে’র মেকআপ প্রোডাক্ট থেকে— ব্লাশ, আইলাইনার, আইশ্যাডো। খুব সুন্দর বেরি, চারকোল, মস্ গ্রিন বা এমারেল্ড গ্রিনের মতো রং রয়েছে।
একটা থিম আগে থেকে নির্ধারিত থাকলে সৃজনশীলতায় বাধা পড়ে না?
সব্যসাচী মুখার্জী: আমি কী করতে চাই সেই ভিশনের সঙ্গে মিলে গেলে কিন্তু খুব একটা বাধা পড়ে না। এবারের ফ্যাশন উইক করার পিছনে একটা বড় কারণ রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে খুব গ্লসি কালেকশন তৈরি করেছি। এবার ইচ্ছে ছিল সেটা একটু টোন ডাউন করে শিমার কালেকশন তৈরি করব। যখন ল্যাকমে’র কাছ থেকে প্রস্তাব পাই ফিনালে করার তখন জানানো হয়, ওদের এবারের থিম শিমার। তাই রাজি হয়ে যাই। আসলে আমার ব্যবসা এখন অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে। আগের মতো যা-ইচ্ছে-তাই করতে পারি না। মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী চলতে হয়। তাই সব সময় একটা পরিকল্পনা থাকে। আমাদের প্রোডাকশনেও সব প্ল্যান অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায়। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে এবারের ল্যাকমে’র থিম মিলে গেল বলেই রাজি হলাম।
বলিউডের শো-স্টপার নেওয়া আপনার অপছন্দ। কিন্তু এবার সেই নিয়মটা ভাঙতেই হল। ‘ল্যাকমে’র ‘ফেস’ হওয়ায় কারিনা কাপুর ফিনালের শো-স্টপার হলেন।
সব্যসাচী মুখার্জী: কারিনার সঙ্গে আগে কখনও কাজ করা হয়নি। আমাদের ‘বাজিরাও মাস্তানি’ করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি বা কারিনা কেউ-ই আর ছবিটা করিনি।
আপনি বরাবরই হ্যান্ডলুম নিয়ে কাজ করে এসেছেন। ইদানীং স্মৃতি ইরানির হ্যান্ডলুম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এতকিছুর পরেও কি আমাদের কারিগরেরা সেভাবে উপকৃত হচ্ছেন?
সব্যসাচী মুখার্জী: সবাই শুধু মুখেই বলেন, আমাদের কারিগরেরা না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছেন। এই পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন সেটা হচ্ছে বুঝতে হবে তো! চাইনিজ জিনিস ব্যবহার করলে দেশি জিনিসের কদর করবে কে? বিদেশ থেকে মেটিরিয়াল কিনে পরলে হ্যান্ডলুম বিক্রি হবে কেন! সচেতনতা বাড়লে তবেই চাহিদা বাড়বে। সেই অনুযায়ী সাপ্লাই চেন বদলাবে। এখন সাপ্লাই অনেক বেশি। যেদিন চাহিদা তার চেয়েও বেড়ে যাবে, সেদিন কারিগরদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিও হবে। আগে বাংলার বাজারে জরদৌসি কারিগরেরা খেতে পেতেন না। কিন্তু আমার ব্রাইডালওয়্যার যখন থেকে জনপ্রিয় হল, তার কপিও মার্কেটে ছেয়ে গেল। তখন সকলে জরদৌসি এখান থেকেই করাতে শুরু করল! এটা পুরোটাই ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের খেলা।
ডিজাইনারেরা এ বিষয়ে কতটা উদ্যোগী?
সব্যসাচী মুখার্জী: একটা কথা আমি মানি যে সবাইকেই হ্যান্ডলুম নিয়েই কাজ করতে হবে, তেমনটা নয়। ধরুন হ্যান্ডলুম নিয়ে কাজ করলে যদি কারও সৃজনশীলতায় বাধা পড়ে, তাহলে সে করবে কেন! কেউ যদি সুইমওয়্যার বা লঁজারি নিয়ে কাজ করে, সে কী করে হ্যান্ডলুম ব্যবহার করবে! তবে এটাও ঠিক, যে দুনিয়াজুড়ে হ্যান্ডলুম খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ মানুষ অনেক বেশি অর্গ্যানিক লিভিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। এটাকে অ্যান্টি-টেকনোলজি মুভমেন্ট বলা হচ্ছে। এখানকার যে ডিজাইনারেরা সেটা টের পেয়েছেন, তারাই কিন্তু হ্যান্ডলুম নিয়ে কাজ করছেন। কারণ এতে তাদেরই লাভ।
‘ক্রিশ্চিয়ান লুবোতঁ’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফুটওয়্যার ডিজাইনিং শুরু করেছিলেন। এই ধরনের ‘কোলাবরেশন’ এর মধ্যে আর করছেন?
সব্যসাচী মুখার্জী: এই কিছুদিন আগেই ‘এশিয়ান পেন্টস’ আর ‘ফরএভার মার্ক’এর সঙ্গে কাজ করলাম। খুব তাড়াতাড়ি আন্তর্জাতিক স্তরে একটা বড় কোলাবরেশনে কাজ করব। কী, এখনই বলতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, দেশের সবচেয়ে বড় কোলাবরেশনের মধ্যে একটা হতে চলেছে। এই কাজগুলোর গুরুত্ব একটাই। দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা গুণ মিলে একটা নতুন কিছু তৈরি হয়। যেমন ফুটওয়্যার ডিজাইনিংয়ে ‘ক্রিশ্চিয়ান লুবোতঁ’র তুলনা হবে না। তবে আমার মতো এমব্রয়ডারির কাজও ওরা করতে পারত না। একসঙ্গে কাজ করলে ফলটা অনেক বেশি সুন্দর হয়।
এত সুন্দরভাবে নিজের স্টোরগুলো সাজান। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং নিয়ে কিছু ভাবছেন না কেন?
সব্যসাচী মুখার্জী: হয়তো সেটাই আমার পরের বড় আন্তর্জাতিক কোলাবরেশন। আসলে সবই আলোচনা স্তরে রয়েছে। বিষয়টা পাকা হলে জানতে পারবেন।
ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কোনও পরামর্শ দেবেন?
সব্যসাচী মুখার্জী: একটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি, দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেতে গেলে নিজের শিকড়গুলো আঁকড়ে থাকতে হবে। আমার এখনও মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী যখন বিদেশে যেতেন, সব সময় শাড়ি পরতেন। বিদেশে আপনার দেশি পোশাক একটা বর্মের মতো। কেউ সেটা নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারবে না! আমি সব সময় বাকিদের বলি, বিদেশে যাওয়ার সময় তাদের পোশাক পরে যাওয়া মানে তাদের অধীনস্থ হয়ে যাওয়া। আমাদের পোশাক পরার মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য ফুটে ওঠে। তাই বিদেশে ডিজাইনার হিসেবে ছাপ ফেলতে হলে, ভারতীয়তা বজায় রাখতেই হবে। শুধু ডিজাইনার কেন, সব ভারতীয়দেরই এই কথাটা মাথায় রাখা উচিত।