banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 777 বার পঠিত

 

বাস্তবতা

 


রেহনুমা বিনত আনিস


১/ পরশুদিন রিহামের শিক্ষক নোট পাঠালেন, ‘রিহাম আজ ক্লাসে প্রচন্ড আপসেট ছিলো। আজ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো পোকামাকড় নিধন। ক্লাসে কিছু বাচ্চা পোকামাকড় মারার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলো। রিহামের খুব মন খারাপ হয়ে যায়। আমরা এই বিষয়ে আগামী কয়েকদিন আলোচনা করব। রিহামের ব্যাপারে চিন্তিত বোধ করছি’।

অফিস থেকে ফিরতেই রিহাম দরজা খুলল, গম্ভীর চেহারা, ‘টিচার তোমাকে নোট পাঠিয়েছেন’। এর অর্থ হোল ব্যাপারটা যাই হোক না কেন, সেটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জুতোটা খুলেই বললাম, ‘নিয়ে এসো’। নোটটা আনতে আনতে ওর গলা বন্ধ হয়ে এলো, চোখ ছলছল করতে লাগল। কিন্তু সে কিছুতেই জনসমক্ষে কাঁদবেনা। আমার ছেলেটা যে কিভাবে আমার মতই হোল! কত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে, অথচ মনের কথা মুখে আনতে পারেনা। নোটটা পড়ে আগে ওকে কোলে বসিয়ে, জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিলাম। বাইরে সে যতই নিজেকে বিজ্ঞানী মনে করুক না কেন, ভেতরে তো সে একজন কোমলপ্রান শিশুই! রিহাম কিছুটা শান্ত হয়ে এলে বললাম, ‘আসলেই তো, যে প্রান মানুষ সৃষ্টি করেনি সে প্রান মানুষের ধ্বংস করার কোন অধিকার নেই’। সে বুঝল আমি ওর মনের কথাটা বুঝেছি। তারপর যুক্তিগ্রাহ্য উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বললাম কেন মাঝে মাঝে কিছু কিছু প্রানীর ক্ষতির সম্ভাবনা হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের হত্যা করতে হতে পারে। ওর উদার বিজ্ঞানী মন এই যুক্তিতে খুব একটা খুশি হতে পারলনা, মানুষ সব প্রানীকে বিলুপ্ত করে ফেললে কি করে চলবে? কিন্তু আবার বাস্তবতাও অস্বীকার করতে পারলনা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। সিনারিওটা ওর পছন্দ না হলেও সত্যটা সে মেনে নিলো।
কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ওর শিক্ষকের নোটের জবাব দিলামঃ ‘সুপ্রিয় শিক্ষক, রিহামের প্রতি আপনার সচেতন নজরের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনি তো জানেন রিহাম প্রানীদের ভালোবাসে এবং এই ভালোবাসা পোকামাকড়দের প্রতিও বিস্তৃত। একবার ওর বোন একটা মাছি মেরেছিল বলে রিহাম এক ঘন্টা কেঁদেছিলো। আমি কখনোই চাইনা জীবজগতের প্রতি ওর এই মায়া হারিয়ে যাক। আমি চাইনা সে এমন মানুষে পরিণত হোক যে প্রানীহত্যা করে আনন্দ পায়, সেটা হোক পোকামাকড় কিংবা গাছপালা। তবে ওকে এটাও জানতে হবে, মানুষ বড় স্বার্থপর প্রানী, সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবেনা, এমনকি অপর কোন মানুষকে নিয়েও না। রিহামকে ধীরে ধীরে এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আপাতত যতটুকু ওর জানা প্রয়োজন সেটুকু আমি ওকে বুঝিয়েছি। বাকীটার জন্য প্রয়োজন অল্প সময় আর অনেক টিস্যূ পেপার’।

২/ আমার মেয়ের মাশাল্লাহ জন্মগতভাবেই প্রচুর যোগ্যতা। ওর দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায় ওর কোন কিছুই আমার মত নয়। বরং সে ছোটবেলা থেকেই মনে করে এই বে-গুন মা’টাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা ওর নৈতিক দায়িত্ব। সে দেড় দু’বছর বয়স থেকেই স্বাবলম্বী। চার বছর বয়সে সে আমাকে কোলে নিতে পারত। সাত আট বছর বয়স থেকে সে ওর বাপের বয়সী লোকজনকে কার্যকর পরামর্শ দিতে পারত। দশ বারো বছর বয়সে সে একাই একটা সংসারের দায়িত্ব নেয়ার উপযুক্ততা অর্জন করে। ইদানিং সে স্কুলে এবং অন্যান্য জায়গায় বিভিন্নপ্রকার প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করার দায়িত্ব পায় যেখানে ওর চেয়ে বয়সে বড় ছেলেমেয়েরাও ওর নির্দেশ পালন করে। অতিরিক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকজনের সমস্যা হোল ওরা সিদ্ধান্ত দিতে এত অভ্যস্ত হয়ে যায় যে ওরা ভুলে যায় মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত নিতেও হয়, অন্যের সিদ্ধান্ত। বরং ওরা অন্যের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করার চেয়ে নিজের ভুল সিদ্ধান্তে ভরসা করাই শ্রেয় মনে করে। রিহামকে যুক্তি দিয়ে বুঝানো যায়। কিন্তু রাদিয়ার জন্য কেবল একটি নিয়ামকই প্রযোজ্য, ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার ত্যাগ, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু কেবলমাত্র এই মহাবিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন অংশীদার নেই, আমি এভাবেই নির্দেশপ্রাপ্ত, এবং আমি আত্মসমর্পনকারীদের মাঝে অগ্রনী’ (সূরা আন’আমঃ আয়াত ১৬২-১৬৩)। বাবামা সন্তানকে কতটুকুই বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যদি না এর নিয়ামক হয় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য?

৩/ আমি যখন কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরোই তখন বাজে ভোর পৌণে ছ’টা। পৌঁছই তখন ছ’টা বিশ। এই আধঘন্টা আমার দিনের সবচেয়ে প্রিয় সময়। শুধুমাত্র ভরগ্রীষ্ম ব্যাতীত এই সময়টা থাকে অন্ধকার। প্রকৃতি তখনও ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠেনা। আমরা ক’জন ভোরের পাখি ছাড়া কোন বাড়ীতে আলোও দেখা যায়না। কখনো নিঃশব্দ তুষারপাত, কখনো টুপটাপ বৃষ্টি। এছাড়া অধিকাংশ সময় প্রকৃতি থাকে নীরব নিস্তব্ধ। এই সময়টা আমার ভীষণ ভাল লাগে। এই মৌনতা আমার ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এ’সময় আমি নিত্য নতুন প্রেমে পড়ি। কিন্তু আগের প্রেম তার জৌলুস হারায়না, আবার নতুন প্রেম পুরোনোকে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনা। তারা সকলে মিলে আমার মনের ভেতর সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। আমার লেটেস্ট প্রেম হোল এই দু’টির দ্বিতীয়টি, আমার পুত্র কিছুক্ষণ পর পর এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে বলে, ‘মি লাভ মাই আম্মু সোওওওওওওও মাচ! মি গিভ মাই আম্মু আ বিইইইইইগ হাগ’। তারপরও সেদিন আমি অফিস থেকে ফেরার পর সে ব্যাস্ত ছিলো বলে আমি অভিমান করে বললাম, ‘আজ কিন্তু তুমি তোমার সবচেয়ে জরুরী কাজটা করনি’। বুদ্ধিমান পুত্র বুঝতে পেরে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল। ভাবি, আমি কবে আমার প্রভুকে মন খুলে বলেছি, ‘ভালোবাসি!’ তবু তিনি আমাকে দিয়ে যাচ্ছেন, অকাতরে, এত বেশি যে মাঝে মাঝে ভয় হয় ওদিকের জন্য বুঝি আর কিছু বাকী রইলোনা।
আবার ভাবি, শুধু ভালোবাসি বলাই কি যথেষ্ট? যেমন কেউ একজনের কাছে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে একজন মুরুব্বীর কাছে সমাধান চাইলাম। তিনি সমাধান দিলেন, ‘তুমি তো জানোই সে সেরকম। তোমারই ভুল হয়েছে। তুমি ওকে সামলে চলতে পারোনি’। বাহ! সে সেরকম সেটা অন্যায় নয়, আর আমি টুঁ শব্দ করলেই অন্যায়! সরে এলাম। আমি সবসময় এসব জায়গা থেকে সরে আসি। সবাই ভাবে আমি সরে আসি কারণ আমি বোকা। কিন্তু না, আমি সরে আসি কারণ আমি বুদ্ধিমান। মানুষের কাছে অধিকার চেয়ে লাভ কি? আমার প্রভুর কাছে প্রতিদান চাইলে পাব ঢের বেশি।

কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হোল আমি বললাম, ‘ভালোবাসি’। কিন্তু আমার চিন্তাচেতনা তাঁর পছন্দ অপছন্দকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না, আমার কথায় কাজে তাঁর প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেনা, আমার সময়ে তাঁর কোন অধিকার চোখে পড়েনা, তবে এই মৌখিক প্রকাশের কতটুকু মূল্য থাকে?
৪/ কিভাবে কিভাবে যেন আমার অফিসেই সবসময় গল্পের আসর বসে। আমি যেহেতু অনেক ভোরে কাজ শুরু করি, যতক্ষণে অন্যরা গল্পের মুডে আসে ততক্ষণে আমার দিনের অর্ধেক পেরিয়ে যায়, সুতরাং আমিও সময় দিতে পারি। মাঝে মাঝে আমাদের গল্পসল্প অদ্ভুত মোড় নেয়। যেমন আজ জিং বাবামা নিয়ে গল্প শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তা এসে ঠেকল খাবারে। লোভনীয় সব খাবারের আলোচনার মাঝে আমি বাগড়া দিলাম আমার অদ্ভুত চিন্তা দিয়ে, ‘আচ্ছা, এখন যদি ডাইনোসর পাওয়া যেত এবং সেটা খাওয়া যেত তাহলে কতজন মানুষ কতদিন যাবত একটা ডাইনোসর খেতে পারত’।
ক্যারী বলল, ‘সেটা তো ডাইনোসরের সাইজের ওপর নির্ভর করে, তাইনা? কিছু কিছু ডাইনোসর ছিলো অনেক ছোট। আবার কিছু কিছু ছিলো অনেক বড়। তবে ধর যদি আমরা একটা মাঝারী আকারের ডাইনোসর ধরি, যেমন টি-রেক্স, তাহলে একটা হিসেব করে দেখা যেতে পারে’।

আমার চিন্তাটা ‘টি-রেক্সকে কিভাবে ধরাশায়ী করা সম্ভব তার খাবারে পরিণত না হয়ে’র দিকে ধাবিত হওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিলো, কিন্ত আমি তাৎক্ষণিক উত্তর দিলাম, ‘নাহ, টি-রেক্স খাবনা। সে হিংস্র। ব্রন্টোসরাস পেলে খেতে পারি’।
ক্যারী মুচকি হেসে চলে গেল যার অর্থ হোল, ‘বুঝলে তো, যে হিংস্র তাকে কেউ কিছু বলেনা। হম্বিতম্বি যা চলে সব নীরিহের ওপর। এটাই জগতের নিয়ম’।

হুমম, বুঝলাম। শেষপর্যন্ত আমার যুক্তি, আমার আনুগত্য, আমার বিনয়, আমার ভদ্রতা পরাজিত হোল এই জগতের নিয়মের কাছে যার অযৌক্তিকতা নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলাপ করছিলাম।

Facebook Comments