অপরাজিতা ডেস্কঃ ছোটবেলা থেকেই ট্রেন জিনিসটা ছিল উম্মে সালমা সিদ্দিকার কাছে এক দুর্বার আকর্ষণের বিষয়। চিটাগং শহরস্থ বাসায় থাকাকালে যখনই ট্রেনের হুইসেলটা তার কানে ভেসে আসতো, তার মধ্যে বয়ে যেত এক আনন্দের স্রোত। বড় হতে থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে এই বিশ্বাসটা সবসময় প্রগাঢ় ছিল যে, সব ট্রেনই স্ব-চালিত, এর কোন ড্রাইভার লাগে না। বুদ্ধিমান হওয়ার পরই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার প্রতিদিনের দেখা ট্রেনের রহস্য আসলে তিনি যা ভেবে এসেছেন তা না।
২০১১ তে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি ট্রেনচালক হবেন, এবং তিনি বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগদানও করলেন।
তারই পথ ধরে আজ তিনি ট্রেনচালক হবার পথে, এমন এক পেশা, যে পেশাটি এতকাল পুরুষের একচ্ছত্র করায়ত্তে ছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে এই মুহূর্তে ১২ জন নারী সহকারী রয়েছেন যাদের পদমর্যাদা হলো এসিস্ট্যান্ট লোকোমোটিভ মাস্টার্স (ALMs), তবে এখনো কোন পূর্ণ-পদপ্রাপ্ত নারী লোকো (Loco) মাস্টার নেই।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, আরো ৩জন নারী গত নভেম্বরে ALM রিক্রুটমেন্ট টেস্টে উত্তীর্ণ হয়েছেন। টাঙ্গাইলের সালমা সিদ্দিকা হলেন প্রথম বাংলাদেশী নারী যিনি ২০০৪ এ ALM পদে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেন।
উম্মে সালমা সিদ্দিকার এখনকার কাজ হলো ট্রেন ড্রাইভারদেরকে তাদের চালনায় সহযোগিতা করা এবং সহযোগিতা করার তার এ অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে হবে ট্রেনচালক হবার নিয়ামক। তার চাকুরীর দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো, যে সময়টায় Loco Master ট্রেন চালাচ্ছেন রেলওয়ে সিগনালগুলোর এবং রেল ট্র্যাকের পজিশন খেয়াল রাখা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের East Zone এর চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হারুন-আর-রাশিদ আমাদের জানান যে, একজন ALM এর ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে একজন LM (Loco Master) হওয়ার জন্য।
বৃটিশ ঔপনিবেশকরা যখন এই উপমহাদেশে রেলপথের সূচনা করেছিল, সে ট্রেনগুলোর শক্তির উৎস হিসেবে ছিলো কয়লা-চালিত বাষ্প ইঞ্জিন। সে সময়ের ট্রেন চালনা ছিল নারীদের জন্য অত্যন্ত শ্রমসাধ্য একটা কাজ এবং তাদেরকে বিবেচনায়ও আনা হতো না। বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়, মানুষের মন-মানসিকতাও পরিবর্তন হয় এবং সেই সাথে লোকোমোটিভদেরও।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন মহা-পরিচালক মোহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন বলেন, স্বল্প সংখ্যায় করে হলেও বাংলাদেশের নারীসমাজ যে এই পেশার দিকে ঝুঁকছে, পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিছে, ব্যপারটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। তার ভাষ্যে, এই মেয়েরাই হলো নারীসমাজের যোগ্যতার উজ্জ্বল নিদর্শন; এরা সব কাজ করতে সক্ষম।
সিদ্দিকা যে ট্রেনটির লোকো মাস্টারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন সে ট্রেনটি হলো চিটাগং ইউনিভার্সিটি কম্যুটার ট্রেন যা যাতায়াত করে ইউনিভার্সিটি এবং বন্দর নগরী এ দুয়ের মধ্যে।
“আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে এ পেশায় আছি এবং এটা বেশ রোমাঞ্চকর”, তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন। সেই সাথে তার ফ্যামিলি তাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে তিনি নিজ পরিবারের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
কিন্তু নারী ALMদের জন্য সবসময়ে পরিস্থিতি এতটা সহজ ছিলো না।
ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ম্যাথমেটিকসে অধ্যনকারী কুলসুম আখতার ALM আমাদের জানান, কর্তব্য পালনকালে তিনি নানান বিপত্তির সম্মুখীন হন। তিনি বলেন, “লোকজন প্রায়ই লোকোমোটিভের মধ্যে একজন মেয়েকে কাজ করতে দেখলে আপত্তিকর মন্তব্য ছুঁড়ে মারে”।
কুলসুমের মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী এবং তাদেরও একই রকম চাকুরীর প্রয়োজন হয়। তাই নারীদের প্রতি এধরণের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে পরিবর্তন হওয়া দরকার।
তিনি আরো জানান, শুধুমাত্র এসব সামাজিক ও চিরাচরিত বিধি নিষেধের দরুন নারীদেরকে অনেক সময়ই ট্রেন চালনার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক নারী ALM বলেন, এই নিরাপত্তা বিষয়ক দুশ্চিন্তার অবকাশ থাকার কারণেই এত অল্প সংখ্যক মেয়ে এই পেশায় আসে।
তিনি এও যোগ করেন, “নারীর নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা এটা সরকারেরই কর্তব্য”।
সূত্র- ডেইলি স্টার।
অনুবাদ করেছেন- মুসবিহা।