banner

রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 28 বার পঠিত

 

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা: ২০২৪ সালের জরিপে উদ্বেগজনক চিত্র

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে পরিচালিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’–এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়, যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭০ শতাংশ নারী তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন নিজের স্বামী বা জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে। নন-পার্টনার সহিংসতার তুলনায় স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার হার অনেক বেশি, যা নারীদের নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা আরও গভীরভাবে প্রকাশ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের ওপর সহিংসতার হার বিগত বছরগুলোর তুলনায় খুব একটা কমেনি। ২০১৫ সালের জরিপে জীবদ্দশায় সহিংসতার হার ছিল ৭৩ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে সামান্য কমে ৭০ শতাংশ হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ১২ মাসের হিসেবে এই হার ৪১ শতাংশ, যা এখনো যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বিশেষ করে শারীরিক সহিংসতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারীরা স্বামীর কাছ থেকে তিনগুণ বেশি নির্যাতনের শিকার হন, আর যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা ১৪ গুণ বেশি।

এছাড়া, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি সহিংসতার শিকার হন। গবেষণায় উঠে এসেছে, এইসব এলাকার নারীরা তাঁদের জীবদ্দশায় এবং সাম্প্রতিক ১২ মাসে অদুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারীদের তুলনায় বেশি মাত্রায় সহিংসতার সম্মুখীন হন। অর্থাৎ, পরিবেশগত ও আর্থসামাজিক কারণ নারীদের প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে আরও তীব্র করে তোলে।

এই জরিপে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো—নারীদের ৬৪ শতাংশ তাঁদের ওপর হওয়া সহিংসতার কথা কাউকে বলেন না। পারিবারিক সুনাম রক্ষা করা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ এবং সমাজে সহিংসতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি এর মূল কারণ। অনেক নারী মনে করেন, সহিংসতার শিকার হওয়ার পরও চুপ থাকা তাঁদের জন্য নিরাপদ, কারণ বিচারপ্রক্রিয়ায় জটিলতা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া তাঁদের পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে।

জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব আলেয়া আক্তার। এছাড়া ইউএনএফপিএর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে এবং অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার ক্লিনটন পবকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

এই জরিপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৭,৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। এতে শহর, গ্রাম, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা এবং বস্তির নারীদের অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পুরো দেশের পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
জরিপের ফলাফল স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, নারীর প্রতি সহিংসতা এখনো বাংলাদেশে একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এটি মোকাবিলার জন্য আইন ও নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন, নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। তা না হলে, নারীরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনযাপন করতে বাধ্য হবেন, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও ব্যাহত করবে।

তথ্যসুত্রঃপ্রথম আলো

Facebook Comments