গাজী আনোয়ার শাহ্
পথের পাঁচালী
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইরানি মুভি “দ্যা চিলড্রেন অফ হ্যাভেন” অসাধারণ খ্যাতি কুড়িয়েছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিশীল শিল্প প্রতিভা দ্বারা। যে মুভিটি হিন্দিতেও নকল করা হয়েছে। এক বাক্যে অসাধারণ। ছোট বাচ্চা (ভাই, বোন) দুটির কর্মকুশলতা, ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে আহত পরিবারের এক অনন্য সমাচার।
বাংলা সাহিত্যের টর্চবিয়ারার, মশালবাহি লেখকের “পথের পাঁচালী” এমন একটি বাস্তব, জীবন্ত, সার্বজনীন রচনা যার স্বীকৃতি সর্বশেষ অস্কার পর্যন্ত পৌঁছেছে।
চলচ্চিত্র হিসেবেও এর খ্যাতি রয়েছে
পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রযোজিত ও সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটিবাংলা চলচ্চিত্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরউপন্যাস পথের পাঁচালী অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটিসত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। অপু ত্রয়ীচলচ্চিত্র-সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীর মুখ্য চরিত্র অপুর শৈশবকে কেন্দ্র করে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনধারা চিত্রায়িত করা হয়েছে।
**৯৫৫শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার(স্বর্ণকমল পুরস্কার)
**শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার(রজতকমল পুরস্কার)
**৩য় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত) ভারত১৯৫৬পাল্ম দর
**শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল
**ওসিআইসি পুরস্কার – বিশেষ উল্লেখ১৯৫৬
** ৯ম কান চলচ্চিত্র উৎসব ফ্রান্স
১৯৫৬ ভ্যাটিকান পুরস্কার, রোম– ইতালি
১৯৫৬ গোল্ডেন কারবাও, ম্যানিলা– ফিলিপাইন
১৯৫৬ মেধার ডিপ্লোমাএডিনবরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব স্কটল্যান্ড
১৯৫৭ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য ‘সাজনিক গোল্ডেন লরেল’বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব জার্মানি
১৯৫৭শ্রেষ্ঠ পরিচালক জন্য গোল্ডেন গেট
শ্রেষ্ঠ ছবি জন্য গোল্ডেন গেটসান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব যুক্তরাষ্ট্র
১৯৫৮শ্রেষ্ঠ ছায়াছবিভ্যানকুভার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কানাডা
১৯৫৮ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড স্ট্র্যাটফোর্ড ফিল্ম ফেস্টিভাল কানাডা
১৯৫৮ সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র, জাতীয় বোর্ড পর্যালোচনা পুরস্কার
১৯৫- যুক্তরাষ্ট্র১৯৫৯সেরা বিদেশী চলচ্চিত্রনিউইয়র্ক চলচ্চিত্র উত্সব যুক্তরাষ্ট্র
১৯৬৬কিনেমা জাম্পু পুরস্কার সেরা বিদেশী চলচ্চিত্র জন্য– জাপান
১৯৬৯শ্রেষ্ঠ অইউরোপীয় ছায়াছবির জন্য বদিল পুরস্কার– ডেনমার্ক হতে পুরুষ্কার লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথের অনুগামী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার গ্রামীণ জীবনের ছিন্নমূল প্রান্তিক পর্যায়ের পরিবার গুলোর একটি জীবন বৈচিত্র্য শিল্পীর তুলিতে অঙ্কন করে জনমানুষের হৃদয়ে যায়গা করে নিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের জীবননান্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পুতুল নাচের ইতিকথা”, জহির রায়হানের “হাজার বছর ধরে” এর মত অনেক লেখকের মত গ্রাম বাংলার চিত্র জীবন্ত করে উপস্থাপন করেছেন।
উপন্যাসটির প্রাধান চরিত্র দুই ভাইবোন অপু ও দূর্গা।
উপন্যাসটি সাধু ভাষায় বলে সুখপাঠ্য নয়, ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পড়তে হবে। প্রথমে কঠিন মনে হলেও চরিত্রগুলো খুঁজে নিতে পারলে রসালো হবে।
সারসংক্ষেপ
পথের পাঁচালী’ প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা একটি বিখ্যাত সামাজিক বাস্তব উপন্যাস। এটি উপন্যাস হলেও পড়ার সময় একটিবারের জন্যও মনে হয় না যে এটা উপন্যাস। বরং লেখকের স্বচ্ছ -সাবলীল ভাষায় আমাদের সমাজের বাস্তব ও জীবন্ত ছবিটিরই একটি সহজ-স্বাভাবিক রূপ তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে।
আমরা, থার্ড জেনারেশান, কখনও কী ভেবেছি যে একজন নারীর কিরকম অনুভূতি হয় যখন সে ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত, অবহেলিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হয়, কারণ তার কোন আয়ের উৎস নেই, ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, গঠনগত দূর্বলতার কারণে?
যখন একজন পরিচারিকা তার জীবনের শেষ দিনে চলে আসে, তখন তার সামাজিক পরিস্থিতি কেমন হয়? যখন কোন নারী অল্পবয়সে স্বামী হারা হয় এবং সমাজ তাকে আবার বিয়ে করবার অনুমতি দেয় না, তখন সেই নারীর সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর অত্যান্ত নিখুঁতভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” উপন্যাসে রয়েছে।
এই উপন্যাসের প্রথম অংশে আমরা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি বাল্যবিবাহ ও যৌতুককে দানবীয় আকার ধারণ করতে দেখি। ইন্দির ঠাকুরনের বিয়ে অল্পবয়সে এমনই এক লোকের সাথে লোকের সাথে দেয়া হয়, যে বেশি যৌতুকের লোভে অন্যত্র বিয়ে করেন এবং আর কখনও ফিরে আসে না। তখন আয়হীন ইন্দির ঠাকুরনের আবাসস্থল হয় তার পিতার বাড়িতে, এবং তাদের ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হরিহরের বাড়িই তার স্থান হয়।
সেখানে প্রতিমুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেয়া হত যে সে একজন আশ্রিতা, করুণার পাত্রী ছাড়া আর কেউ নয়। সে প্রায়শই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, কিন্তু দিন শেষে তার পথ এসে শেষ হত হরিহরের বাড়িতেই। একবার ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে তাকে একেবারে বের করে দেয়া হয় এবং মর্মান্তিকভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে। মৃত্যু হয় অসহায়ত্বেরর।
এই উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ ‘আম আঁটির ভেঁপু’-এ অত্যন্ত সুচারুভাবে হরিহরের সন্তানদ্বয়- বড়মেয়ে দূর্গা ও ছোট ছেলে অপুর টক-মিষ্টি সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।
দূর্গা একপর্যায়ে অপুকে মারে, কারণ সে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চুরি করে আম খাওয়ার ঘটনা বলে দেয়। এই কারণে তাকে প্রতিবেশীর কথাও শুনতে হয়। রাগের মাথায় দুর্গার মা সর্বজায়া ওকে বকাবকি করেন। উপন্যাসের এক পর্যায়ে ম্যালেরিয়া জ্বরের শেষ পর্যায়ে এসে দুর্গা মারা যায়।
উপন্যাসের শেষ অংশ ‘অক্রুর সংবাদে’ চিরাচরিত বাংলার বড়লোক-গরীবের বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
লেখক সাফল্যের সাথে দেখিয়েছেন, যে একজন ব্রাক্ষ্মণ নারীর(সর্বজয়া) কি অবস্থা হয়, যখন অর্থের জন্য তাকে কাজের লোকের কাজ করতে হয়। দুর্গার মৃত্যুর পর তারা গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে এক পর্যায়ে জ্বরে স্বামী হরিহরও মারা যায়। তার চোখের অশ্রু মোছার জন্যও কেউ ছিল না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়। সাহায্যের হাত কেউ বাড়ায় না।
অবশেষে সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলে অপুকে নিয়ে তার নিজ গ্রাম নিশ্চিন্দি পুরের পথে রওনা হয়। কিন্তু সে তার সঠিক পথ খুঁজে পায় না।
কিন্তু বলাই বাহুল্য যে এই সামাজিক বৈষম্য আজকের একবিংশ শতাব্দিতে এই উন্নত সমাজেও পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত এই উপন্যাস আদি ও বর্তমান সামাজিক উত্থান-পতন ও সামাজিক কুসংষ্কারেরই প্রতিচ্ছবি।
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জন্ম:১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয়ভারতীয় বাঙ্গালি কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।
পথের পাঁচালী ও অপরাজিত তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত উপন্যাস। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী ও অশনি সংকেত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ প্রায় ২০টি গল্পগ্রন্থ, কয়েকটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস ও কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী এবং দিনলিপিও রচনা করেন।
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনেসত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কাররবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
অধুনা ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলাতে, ১ নভেম্বর ১৯৫০ তিনি মারা যান।
আনোয়ার শাহ্
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,
আরবি বিভাগ,
৪র্থ বর্ষ।