banner

মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 718 বার পঠিত

 

বই ও বেপরোয়া আমি ২

তাহেরা সুলতানা


আমি বরাবরি ডিটেক্টিভ থ্রিলার ধরনের বইয়ের বেশী ভক্ত ছিলাম। ছিচকাদুনে টাইপ প্রেমের গল্প উপন্যাস কখনোই খুব একটা ভালো লাগতো না। তবে আজ আর বাইরের বই না, আজ আমার গল্পের সঙ্গী পাঠ্যপুস্তক। আমার কাছে বই মানেই শুধু বই। পাঠ্যপুস্তক না বাইরের বই, সেটা কখনোই আলাদা করতে পারতাম না! ‘পড়তে বস’, এই কথাটা আমাকে আল্লাহর রহমতে কোনদিন বলতে হয়নি। পড়াই যেন ছিল আমার জীবনের সবকিছু! নতুন ক্লাসে ওঠার অনেক আগেই পুরনো বই সংগ্রহ করে রাখতাম। ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই প্রায় সব বই পড়া হয়ে যেত। এখনো আমার হাতে যেকোন বই আসলেই আফিমের নেশা ধরে যায়! শুনলে অবাক হবে, আমি এখনো স্কুলের সিলেবাসভুক্ত বইগুলো পড়ি! আর বাংলাদেশে আমার ৭/৮ বছরের শিক্ষকতা পাঠ্যবইয়ের সাথে নতুন করে সখ্যতা তৈরী করেছে। তবে বইয়ের প্রতি বেপরোয়া ভাব আমাকে যে শুধু বিপদেই ফেলেছে, তা কিন্তু নয়! অনেক কঠিন সময় থেকে উৎরাতেও সাহায্য করেছে!
যখন ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙল, সেই সময়টাতে বাংলাদেশেও উত্তাল অবস্থা বিজার করছিল। আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে প্রায় ৫০ ভাগ লোকই হিন্দু ছিল। আব্বা তখন টানা ৩ রাত বাসায় ছিলেন না। আমি বাসার বড়, তাই আম্মার সাথে প্রায় সারারাতই জেগে থাকতে হতো, কখন আব্বা ফিরেন! আমার কাছে কৌতুহল ছিল, আব্বা কোথায় যেতেন! পরে জেনেছিলাম, আব্বা তার ২/৩ জন কলিগসহ সারারাত গ্রামের কালিমন্দির পাহারা দিতেন। বলতেন, “অনেক মুসলমান খেপে গিয়ে মন্দির ভাঙছে। এটা তো ঠিক না। এই দেশের সাধারণ হিন্দুরা তো কোন দোষ করেনি।”
তখন একমাত্র বইই ছিল আমার আমার রাত জাগার সঙ্গী!
পানি সবার আগে ঢুকে। আমরা যে বাসাটায় থাকতাম, সেটায় বন্যার পানি ঢুকতো না, কিন্তু চারপাশে হাটু পানি থাকতো। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ! কোন কাজ নেই! স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য যতটা না মন খারাপ হতো, অনেক বই পড়তে পারবো, সেই আনন্দই বেশী কাজ করতো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়িতে বেশ সাপের উপদ্রব হতো। আব্বা আম্মা খুব সজাগ থাকতেন।

একদিন রাতের বেলা, আমার ভাইবোনরা সবাই ঘুমিয়ে গেছি। তখন হালকা শীত পড়েছে। আমি একা মেঝেতে পাটি পেতে বসে বই পড়ছিলাম। গল্পের বই না, পাঠ্যপুস্তক। আম্মার একটা লাল চাঁদর ছিল, ওইটা ছড়িয়ে দিয়ে সারা গা, মাথা, পা ঢেকে পড়ছি। আমি আগেই বলেছি, বই হাতে থাকলে দুনিয়ার কিচ্ছু মাথায় থাকে না! তাই আমি খেয়ালই করিনি, কখন যে একটা সাঁপ এসে আমার চাঁদরের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে! হঠাৎ করে মনে হলো ঠান্ডাটা একটু বেশীই লাগছে! বাম দিকে ফিরেই আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা আওয়াজ বের হলো, “আব্বা!” এরপর মুখ দিয়ে শুধু আ! আ! বেরুচ্ছে। কোন আওয়াজ নেই! আব্বা আম্মা বারান্দায় আধো আধো চাঁদের আলোয় বসে গল্প করছিলেন (আব্বা আম্মা ২ জনই অসম্ভব রোমান্টিক মানুষ! এখনো তারা একজন আর একজনকে ছাড়া কিছুই বুঝেন না)।

‘আব্বা’ ডাক শোনার সাথে সাথে ২ জনই ছুটে আসেন। আম্মার সিক্স সেন্স অসম্ভব প্রখর! আর উনি অনেক বেশী সাহসী আর ধৈর্যশীল একজন মানুষ। আম্মার এই বিশেষ ৩ টা গুনের জন্য আমরা সবাই আল্লাহর রহমতে বহুবার বহু বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে! আম্মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তাই একটা বড় লাঠি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর যে ঘটনাটা হয়, সেটা আমার পরে আম্মার কাছ থেকে শোনা। আম্মা নাকি দেখেন, সোডিয়াম আলো আর চাঁদরের লাল রং এর প্রতিক্রিয়ায় সাঁপটা আর তাকাতে পারছিলো না, তাই ওই চাঁদরের উপরই কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ছিল! আব্বা আমাকে দ্রুত কোলে করে খাটে তোলেন আর আম্মা সাঁপটা মারেন। আমি তো চোখ বন্ধ করে মটকা মেড়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে আছি! আব্বা আমাকে সাহস দেয়ার জন্য সাঁপের গুষ্টি উদ্ধার করছেন আর এদের সবচেয়ে কম ক্ষমতাসপন্ন প্রজাতির জীব হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন! অবশেষে আমি চক্ষু মেলিয়া তাহাকে দেখিলাম! প্রায় ৫ হাত লম্বা একটি ঢোড়া সাঁপ! ততক্ষণে মরে ভূত! পরেরদিনই আব্বা আমাদের জন্য পড়ার টেবিল আর চেয়ারের ওর্ডার দেন। পরে জেনেছিলাম, আম্মা নাকি আব্বাকে বারান্দায় টেবিলের কথাই বলেছিলেন! আমার এতো পড়ার নেশা! এভাবে মেঝেতে বসে পড়ি! সাঁপ পোকামাকড় আসে কিনা! আমি আজও সাঁপ ভীষণ ভয় পাই! আজও সাঁপের কোন মুভি তো দেখতে পারিই না, কোন মুভিতে সাঁপ থাকলে হয় টেনে দেই, নয়তো চোখ কান বন্ধ করে রাখি।

আর একটা ঘটনা এখনো মনে খুব নাড়া দেয়! ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। খাবার টেবিলে পড়ে আছে। আর আমি পড়েই যাচ্ছি। আম্মা বারবার ঘুম ভেঙে উঠে বলছেন, দ্রুত খেয়ে শুয়ে পড়তে, নইলে শরীর খারাপ করবে। আমার মনে হচ্ছিল, আম্মা জেগেই আছে, ঘুমাচ্ছে না। আমি শুধু “উঠছি আম্মা” বলেই যাচ্ছি, কিন্তু উঠার নাম নেই! তখন অনেক রাত পর্যন্ত পড়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার।

রাত ১টার দিকে আমাদের পোষা বিড়ালটা খুব দাপাদাপি করে! আমরা ওর নাম রেখেছিলাম চুমকি! আমি বিরক্ত হচ্ছি আর বারবার চুমকিকে ধমক দিচ্ছি! ও আরও বেশি করে দাপাদাপি শুরু করলো! হঠাৎ আমি জানালার ফাক দিয়ে বাইরে আগুন দেখতে পাই! আমাদের রান্নাঘরটা পুড়ছে। আম্মা কখন যে দরজা খুলে টিউবওয়েলের পাড়ে পানি ঢালতে চলে গেছেন, খেয়ালই করিনি! আব্বা আমাকে শুধু চিৎকার করে বলছেন, আমি যেন উনার সার্টিফিকেটের ফাইলটা হাতে নিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যাই। আশেপাশের সবাই ততক্ষণে চলে আসে। আব্বার অনেক ছাত্ররা আশেপাশে মেসে থাকতো। সবাই আসে। কিন্তু আগুন কিছুতেই নিভছে না! আমাদের ঘরের গা ঘেসে দাঁড়ানো আমগাছটাতেও আগুন ধরে গেছে! বড়ই গাছটা জলছে! আমার ছোট ছোট ভাইবোনরা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আব্বা অস্থির হয়ে গেছেন! কি করবেন, বুঝতে পারছেন না! আম্মা কিছুতেই কাউকে টিউবওয়েল পাড়ে যেতে দিচ্ছেন না! মধ্যবিত্ত সংসারে একটা সুই কিনলেও খুব হিসাব করে কিনতে হয়! এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে! বইগুলো পুড়লে কি করে কিনবো! কি করে পরীক্ষা দিবো! তবে সেদিন আমার কি যেন হয়েছিল! বারবার মনে হচ্ছিল, আমিই তো এখন অভিভাবক! আমাকে অস্থির হলে চলবে না! সেটাও কিন্তু ডিটেক্টিভ গল্প পড়ার সুফল!

আমি দ্রুত একটা ব্যাগে করে আব্বার সার্টিফিকেট আর আমাদের সবার পড়ার বইগুলো পাশের বাসায় রেখে আসলাম আর আব্বা পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম! আব্বার ছাত্র আর আশেপাশের চাচারা আব্বাকে শান্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে! আশেপাশের খালাম্মা, আপু আর ভাবীরা ততক্ষণে আমার ভাই বোনদের কোলে করে বের করে আনলো!

হযরত ইব্রাহিম (আ)কে আগুনে ফেলে দেয়া হলে মহান আল্লাহপাক উনাকে যে দোয়া পড়তে বলেন, তার বদৌলতে আগুন ইব্রাহীম (আ) এর জন্য শীতল হয়ে যায়। এই গল্প প্রায় সবার জানা। সেদিন আমিও এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষীও হয়েছিলাম! কিছুতেই যখন আগুন নিভানো যাচ্ছে না, তখন আব্বা তার এক ছাত্রকে এক বাটি পরিষ্কার বালু আনতে বললেন। আব্বা বালু হাতে নিয়ে ওই একই দোয়া পড়ছিলেন, আর আগুনের দিকে ছুড়ে মারছিলেন। কিছুক্ষণ পড় দেখা গেলো, আগুনের কুণ্ডলী বিভিন্ন জায়গায় গোল গোল চাকতির মতো হয়ে গেছে! যেখানে যেখানে দোয়াযুক্ত বালি পড়ছে, সেখানেই এ রকম হয়ে যাচ্ছে! একটা সময় আগুন একদম শান্ত হয়ে গেল! আল্লাহর রহমতে আমাদের ঘরের কোন জিনিস সেদিন নষ্ট হয়নি। শুধু রান্নাঘর, বড়ইগাছ আর আমগাছ পুড়েছিল। আর আগুনের আঁচে আম্মার মুখের একটা পাশ লাল হয়ে গিয়েছিল!

পরে থানা থেকে পুলিশ আসে। তদন্তে বের হয়, আমাদের বাসার রান্নাঘরের ঠিক পিছনেই একটা ছনের ঘর ছিল। কেউ থাকতো না। ওখান থেকেই আগুনটা লাগে। ওই ঘরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বাজারের দিকে চলে গেছে। হরদম লোক যাতায়াত করতো। হয়তো কেউ সিগারেট খেয়ে ওই ঘরের চালে ফেলেছিল! সেদিন যদি রাতজেগে বই না পড়তাম, তাহলে কি যে হতো, আল্লাহ মালুম! এতো বছর পরও মনে হলে শরীর শিউড়ে ওঠে! ওই ঘটনার পর আমরা বহুদিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না! খেতে পারতাম না! তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে, আমি কোন গাঁজাখুরি গল্প বলছি।

চলবে…

পর্ব-১

Facebook Comments