তাহেরা সুলতানা
বইপড়ার প্রতি পাগলামি আমাকে অনেকবার বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। বিপদেও পড়েছি বহুবার। ক্লাস ফাইভে স্কুল, স্কলারশিপ এবং সেন্টার পরীক্ষা শেষে অনেকটা সময় পেয়েছিলাম। তখন সারাক্ষণ হাতে ‘তিন গোয়েন্দা’ থাকতো। বাড়িতে ডাইনিং টেবিল ছিলনা। মেঝেতে পাটি পেতে পড়তাম। বিদ্যুৎ চলে গেলে হারিকেন অথবা মোমবাতিই ভরসা ছিল। একটা কথা না বললেই নয়। কোন বই পড়ার আগে আব্বা সবসময় বলতেন,
“যখন কোন ঐতিহাসিক বা কাহিনীমূ্লক লেখা পড়বে, তখন নিজেকে ওই জায়গায় গিয়ে এমনভাবে দাঁড় করাবে, যেন তুমি চোখের সামনে দৃশ্যগুলো দেখতে পাও। তাহলেই পড়ে মজা পাবে।”
একদিন সন্ধ্যার সময় বিদ্যুৎ ছিলনা, মোমের আলোয় ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ছিলাম। চুল হাতাচ্ছি, আর পড়ছি। কি যে মনোযোগ! কখন যে চুলে আগুন ধরে যায়, টেরই পাইনি। আম্মা রান্নাঘর থেকে গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে। তারপর তো পুরা ইতিহাস! আম্মা সেদিন যে মারটাই না দিছিলেন! অনেকদিন গল্পের বই আর হাতেই নিতে দেননি! আম্মা সব বই আলমারীতে তালা মেরে রেখে চাবি আঁচলে নিয়ে ঘুরতেন। বইয়ের বিরহ যে কি জিনিস, সেদিন বুঝেছিলাম!
আরও সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছিল, যেটা আজও কাউকে বলা হয়নি। ক্লাস এইট এর স্কলারশিপ পরীক্ষার পর আমরা ৩ বোন ট্রেনে করে ছোটমামার সাথে নানুবাড়ি যাচ্ছিলাম। ছোটমামা তখন সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিকম পড়ছিলেন এবং আমরা খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম। কারণ মামা তখন আমাদের একজন বড়ধরনের বই আর ক্যাসেট এর যোগানদাতা। ‘প্রিয় বন্ধু’ নামে শ্রুতিনাটকের ক্যাসেটটা মামাই প্রথম আমাদের উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। মামা খুব ভালো লিখতেন। একটা করে কবিতা লিখতেন আর আমাদের পড়ে শুনাতেন। খুব ভালো গানও গাইতেন।
যাইহোক, আব্বা কিছুতেই মামার সাথে একা ছাড়বেন না। আর উনি কখনোই আম্মাকে ছাড়া আমাদের একা ছাড়েননি। সেবারই এর ব্যতিক্রম ঘটে। মামা কিছুতেই মানতে নারাজ, তাই জোড় করেই নিয়ে যান। বাসেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা বোনেরা ট্রেনে যাব বলে জিদ ধরলাম। তখন সিরাজগঞ্জ থেকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন ট্রেন ছিলনা। ভেংগে ভেংগে যেতে হতো। তাই অনেক সময় লাগতো। পার্বতীপুর গিয়ে যখন চিরিরবন্দরের উদ্দেশ্যে আবার ট্রেনে চড়ি, তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমাদের ৩ বোনের হাতেই ট্রেনে চড়ার পর থেকেই কিন্তু বই ছিলো! স্পষ্ট মনে আছে, আমি মাসুদরানার কোন একটা সিরিজ পড়ছিলাম। আমার ছোট ২ বোন মামার কাছে বসেছিল। ওখানে আর সিট খালি না থাকায় আমি ঠিক বিপরীতদিকে জানালার পাশে বসেছিলাম। বোনদের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করেই সিটটা নিয়েছিলাম। ওপাশে জানালার ধারে চাচার বয়সী একজন মানুষ বসে ছিল এবং আমাকে মা বলেই সম্মোধন করছিল। আমি বরাবরি একটু বোকা টাইপ ছিলাম! তাই সমাজের নোংরা চেহারাটা সবসময় চোখ এড়িয়ে যেতো! তখনকার যুগটা তো আর এখনকার মতো এতোটা খারাপ ছিল না! রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও চাচা তো চাচাই ছিল! আর মা বলে ডাকলে তো কথাই নেই! আমার গায়ে লম্বা গাউন আর মাথায় হিজাব ছিল। অবশেষে ওই চাচার পাশেই একটু দূরত্ব রেখে জানালার সাথে সেটে বসলাম। এরপর তো পুরোপুরি বইয়ে ডুবে গেলাম! ততক্ষণে রাতের আধার ফুটতে শুরু করেছে। হঠাৎ মনে হলো, ওই চাচা আমার গা ঘেসে বসার জন্য বারবার এগিয়ে আসছে। আমি বইয়ে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে প্রথমদিকে খেয়ালই করিনি! তারপর যখন বুঝতে পারলাম, তখন মামাকে ইশারা করে বোঝাতে চাইলাম। মামা উল্টো ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন। কারন আমি নিজেই ওইপাশে বসতে চেয়েছি, মামা নিষেধ করেছিলেন। মামাও হয়তো এতোটা সাংঘাতিক কিছু আঁচ করতে পারেননি! ততক্ষণে ভয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছি! এরপর মামা পুরোপুরি বুঝে যায়, কি সমস্যা হচ্ছে! তখন মামা নিজে সিটটা চেঞ্জ করে ওইপাশে বসেন। মামা চাইলেই একটা হেস্তনেস্ত করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের কথা ভেবে চুপ করে গেছেন।
আব্বা আমাদের ৩ বোনকে এভাবে পাঠিয়ে সে রাতে কিছুতেই ঘুমাতে পারেননি। পরের দিনই আম্মাকে নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে তুলে দেন। ছোটমামা আব্বার কাছে বকা খাওয়ার ভয়ে আমাকে হাওয়াই মিঠাই কিনে দিয়ে বশ করেছিলেন। তাই আর কোনদিনই এই ঘটনা তাদের কান পর্যন্ত পৌছায়নি।
(চলবে)