banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 889 বার পঠিত

 

প্রি- টিনেজার ও টিনেজার প্যারেন্টিং; পর্ব-১

ফাতিমা খান


চাইনিজ ব্যাম্বু ট্রি বা চীনা বাঁশ গাছের জন্মবৃত্তান্ত পড়ছিলাম। অন্যান্য হ
মত ওদেরও আলো, পানি, মাটি আর সারের প্রয়োজন হয়, দরকার হয় নিয়মিত পরিচর্যার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে শুধু ছোট্ট চারা গাছটার জন্ম ছাড়া তাদের আর কোন বাড় বৃদ্ধি দেখা যায়না। পঞ্চম বছর হঠাতই বাঁশগাছগুলো বেড়ে লম্বায় প্রায় ৮০ ফুট হয়ে যায়, সময় লাগে শুধু ছ’সপ্তাহ!
ভাবা যায়?

এবার বলি আসল রহস্যটা কোথায়?

প্রথম চারটা বছর ছোট চারাটা না বাড়লেও নিয়মিত যত্ন আর খোরাক পেয়ে মাটির নিচে একটু একটু করে তার শেকড় মজবুত হয়, আশপাশে মাটি টাকে ইতিমধ্যে শক্ত করে সে আঁকড়ে ধরতে শিখে যায়। তারপর ঐ শক্ত শেকড়ের উপর মাত্র ছয় সপ্তাহে পই পই করে বেড়ে উঠে তার ধড়।

মূল যার শক্ত তাকে ঠেকায় সাধ্যি কার!

‘এগার শেষ করে বারো’তে পা দিয়েছে আমার জাওয়াদ। আমার এই প্রি-টিনেজার ছেলেটার সাথে আচরণগত নির্দেশনার জন্য আমি প্রায়ই প্যারেন্টিং নিয়ে স্টাডি করি। যেহেতু প্যারেন্টিং আর চাইল্ড সাইকোলজি বিষয়ে আমার ফ্যাসিনেশন একটু বেশী, সময় পেলেই এই দুই বিস্ময়কর জগতে প্রতিদিন কিছুটা সময় হলেও ঘুরে আসি।

আমার দুই ছেলে শুধু আমার সন্তানই না, রীতিমত তারা আমার সাধনা। ওদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমার প্যারেন্টিং এর ব্যবহারিক জ্ঞান বাড়ছে প্রতিদিন।

টু বি অনেস্ট, আমার বড় ছেলেকে হ্যান্ডলিং করতে একটা সময় আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়ে ছিল। একে তো প্রথম বাচ্চা, আর তারপর একটু জেদী ও একরোখাও ছিল ছেলেটা। সেই ছোট্টকালে যখন লেবুগাছে লেবু দেখে বলত “লেবু গাছে শুধু লেবুই হবে কেন, তাও আবার একই কালারেরই সব ?” সেই থেকে আজ অবধি তার যাবতীয় গুগলহারা, ভুগোল ছাড়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে নিজেও শিখেছি অনেক কিছু।

প্যারেন্টিং, রহস্যময় বটে, ওই চাইনিজ বাঁশগাছের মতই ! যত্নটাও একটু বেশী দরকার হয়।

“টিন এজ” যদিও খুব রেডমার্কড একটা সময় কিন্তু আদতে পনের বছর পর্যন্ত বাচ্চারা কিন্তু একরকম শিশুই থাকে। এসময় বাচ্চাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয় বাবা মায়ের সাথে “বন্ধুত্বপূর্ণ” সম্পর্ক।

রিসার্চারদের মতে এই বয়সী বাচ্চারা যখন বাবা মা কে বন্ধুর মত কাছে পায় তখন তারা অন্য কোন অজানা পথে পা বাড়ায় না। তাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুধু শোনাই না বরং নিজেকে তার জায়গায় ভেবে এর ঠিকঠাক সাড়া দেয়াটা তাদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরির অন্যতম ধাপ।

আমার ব্যক্তিগত মতামত হল সন্তানের সাথে একটা যৌথ “ইমোশনাল ব্যাংক একাউন্ট” তৈরী করে নিন, যেখানে নেতিবাচক অনুভূতির কোন অবকাশই নেই। এখানে শুধু তার ভাল গুনাগুণ গুলো মূলধন করে তার সাথে আপনার লেনদেন হবে। ভুল সবাই করে, তাকে শুধরে দেয়ার সময় ঐ ইমোশনাল একাউন্টের সুন্দর কথাগুলো দিয়েই তাকে শুধরে দিন।

সন্তান এবং বাবা-মা দুজনে মিলে কিছু ক্লিয়ার কাট ‘নিয়মনীতি’ তৈরী করুন যেগুলো আপনার সন্তানকে তার ব্যবহারিক সীমারেখা বলে দেবে।

“বড়দের কথা শুনতেই হবে” না বলে ” আচ্ছা, আমরা না হয় একজন আরেকজনের মতামতগুলো মেনে নেব” কিংবা “এখন বাইরে যাবে না” না বলে “উইকেন্ডে না হয় আমরা একসাথে যাব” জাতীয় কথাগুলো বলা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত আজ না হয় কাল ঠিক একই ধরনের কথা মানে আপনার কথার প্রতিধ্বনি আপনি ওদের কথায় শুনতে পাবেন। এখানে আরেকটা টিপস খুব কাজে আসবে। তা হল, আপনার সন্তানের ছোটকালের বা ইদানিং কালের কোন ভাল কাজের কথা মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিবেন। ভাল কাজে তাকে উদ্দীপিত করতে এর চেয়ে বড় টনিক আর নেই।

প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, তার নিজস্ব গুনে স্বকীয়। এই ‘স্বকীয়তা’ আল্লাহতায়ালার কাছ থেকেই সে সংগে করে নিয়ে আসে। জন্মলগ্ন থেকেই তাদের এই নিজস্বতা কিছু না কিছু প্রকাশ পায়।তাই আমার সন্তান আমার মতই হতে হবে বা তার ভবিষ্যৎ আমার ইচ্ছানুযায়ী তৈরি হবে এমনটা আশা না করাই ভাল। আমার সন্তান তার নিজের পছন্দ, যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী যদি তার ক্যারিয়ার গড়ে তবে তা হবে অসাধারণ। আমি ডাক্তার বলেই যে আমার সন্তানকে ডাক্তার হতে হবে, এমনটা আবশ্যক নয়। তার অবশ্যই নিজের ‘ফ্রিডম_অফ_চয়েস’ আছে। এটা তার ব্যক্তিত্ব গঠনেও সহায়ক । আমার ছেলেদের ক্ষেত্রে তাদের নিজের জিনিসগুলো ওদেরকেই চয়েস করতে দেই, তবে ভালমন্দের একটা ধারণা আগেই দিয়ে দেই যেন ফাইনাল সিলেকশনে ভুল না হয়।

( চলবে)

লেখিকা: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।

Facebook Comments