“প্রিয় আহবাব”
কামরুন নাহার কণা
মায়ের সালাম আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিস বাবা! জানি ভালো আছিস,খুব ভালো! কেউ কি তার রবের কাছে ভালো না থেকে পারে বল? আমিও আছি আলহামদুলিল্লাহ! আমার রবের কোন সিদ্ধান্তের উপর অভিযোগ কিংবা অসন্তুষ্ট হওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। আলহামদুলিল্লাহ আ’লা কুল্লি হা’ল!!!!
বাবা জানিস, তোর সাথে আমার অনেক কথা জমা আছে! কবে শুনবি বলতো? কতো কথা, কতো ভালোবাসা, কতো মমতা জমিয়ে রেখেছি বুকের খাঁচায়! কিন্তু তুই মা কে এমন করে ফাঁকি দিয়ে উড়াল দিলি! এতো অভিমান বাবা তোর! কিসের এতো অভিমান সোনা? আমার দিকে একবার তাকালিও না! আমি তোর খুব হতভাগী মা, তাইনা রে!!!
কিকরে ভুলবো সোনা বল! গত বছরের এই দিনগুলোতে তোর প্রতিটা হৃদস্পন্দন অনুভব করেছি! সে যে কি এক পরম সুখ সুবহানআল্লাহ!! দুচোখ দিয়ে যদি তোর নড়াচড়া দেখতে পেতাম না জানি কতোই সুখ পেতাম! জানিস, তুই যখন পেটের মধ্যে খুব বেশি নড়াচড়া করতি, আমি অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, আর মনে মনে ভাবতাম, দুনিয়াতে আসলে নিশ্চয়ই খুব চঞ্চল হবি! তোর জন্যে নিজের হাতে কাঁথা সেলাই করে রেখেছিলাম! অনেকেই নিষেধ করার পরও শুনিনি! অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও কাঁথাটা সেলাই করে শেষ করেছিলাম। মনেহয়ছিলো তুই যখন প্রথম আমার কোলে আসবি, তোকে এমন একটা উপহার দেয়া দরকার যেটা সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে! অনেক বড় হয়ে গেলেও তুই জানতে পারবি, এটা তোর মায়ের দেয়া জীবনের প্রথম উপহার! তাই এ পাগলামি! অনেক ভালোবাসা আর মমতা লুকানো ছিলো তাতে বাবা! আজ তোর স্পর্শ মাখা, স্মৃতি মাখা একমাত্র বস্তু হিসেবে সেটিই আমার সম্বল হয়ে আছে! পৃথিবীর আর কোন জিনিসে তোর স্পর্শ নেই, সেই কাঁথাটা ছাড়া! যখন তোকে খুব মনেপড়ে, সেই কাঁথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি। যখন ভিতর টা খুব ভারী হয়ে ওঠে, জায়নামাজে বসে সিজদায় অথবা মুনাজাতে তোর সেই কাঁথাটার মাঝে নিরব অশ্রু গুলো ফেলি, মনেহয় এতে হয়তো আমার রবের আমার প্রতি একটু বেশি করুণা হবে! কেন এমন মনেহয় জানিনা।
বাবা জানিস, তোর জন্মের কয়েক মাস আগেই তোর নাম রেখেছিলাম “আহবাব”। যার অর্থ “সবচেয়ে প্রিয়”! বিশ্বাস কর, সেদিন একবারের জন্যে ভুলেও মনে পড়েনি, সবচাইতে প্রিয় জিনিসই রবকে উপহার দিতে হয়! যাক, তবে আমি মোটেও অসন্তুষ্ট নই। আমি জানি আমার রব আমাকে ঠকাবেন না! সবচাইতে কঠিন এই পরীক্ষায় আমি যেন উত্তীর্ণ হতে পারি, তুই শুধু এই দোয়াটা করিস বাবা! হাশরের দিন, তোর আর আমার মাঝে, কোন ব্যবধান যেন না থাকে!
বাবা এ পরীক্ষা টা বড়ো কঠিন! জানিস, আমি ধৈর্য ধরেছি, সব কথা, ব্যথা, অনুভূতি গুলোকেও কবর দিয়ে দিয়েছি তোর সাথে! তবুও এক অসীম শূন্যতা আমাকে যেনো গ্রাস করে নিয়েছে! যেন সমস্ত পৃথিবীটা আমার বুকের মধ্যে দিয়ে দিলেও এশূন্যতা, এ শুষ্কতা, এ রুক্ষতা দূর হবেনা! কি যে পেলাম, আর কি যে হারালাম, সেটাই শুধু খুঁজে পাইনা!
এ শূন্যতা পৃথিবীর কাউকে বুঝাতে পারিনা! দেখাতে পারিনা! এমনকি আমার রবের কাছেও সবটা বলতে পারিনা, যদিও অনেক কিছুই বলতে চাই! তবে জানি, তিনি তো অন্তর্যামী! তিনি সব জানেন! তিনি সব বুঝেন! তিনি যদি আমাকে ধৈর্য্য না দিতেন, আমি কি পারতাম এতো সহজ ভাবে বেঁচে থাকতে? সবটা মেনে নিতে? এতো সহজ ভাবে তোকে বিদায় দিতে কি পারতাম সোনা?
কলিজা আমার! অনেক ভিক্ষা চেয়েছিলাম তোর প্রাণটা! প্রতিটা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে! কিন্তু আমার রবের সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত! জন্মের পর পরই দশ দিন, দশ রাত তুই NICU তে থাকার পর আর পারছিলাম না! শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সবদিক দিয়ে যখন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছিলাম, সেদিন সব অসহায়ত্ব স্বীকার করে মেনে নিয়েছিলাম, আমার রবের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত! হৃদয়ের সবটুকু মিনতি দিয়ে NICU এর রুমে তোর লাইফ সাপোর্ডের পাশে বসে শেষ বারের মতো দুহাত তুলে প্রভুকে বলেছিলাম- “হে আমার রব! হে জীবন মৃত্যুর চূড়ান্ত ফয়সালাকারী! তোমার নাম রাহমানুর রাহীম! জীবন এবং মৃত্যু তোমার হাতে! আমার এ নাড়ীছেঁড়া ধন, কলিজার টুকরার প্রাণটা তোমার কাছে অনেক ভিক্ষা চেয়েছিলাম! কিন্তু আমি জানিনা, ওর ব্যাপারে তোমার কী ইচ্ছা! যদি তুমি ওর হায়াত লিখে থাকো, তাহলে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আমার মানিক কে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও! আর যদি তুমি ওর হায়াত নাই লিখে থাকো……তবে নিয়ে যাও রব! আমার আর কোন আফসোস নেই! আমি বিশ্বাস করি, সাধ্যাতীত কোন বোঝা তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিবেনা!”
আহা! বাবারে….সেদিনই ছিলো তোর জীবনের শেষ দিন!
সেই যে তিনি আমাকে ধৈর্য দিলেন, আমি আজও আর মন ভরে কাঁদতে পারিনা! আমি যেন কান্না ভুলে গেছি। তোকে জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মতো কোলে পেলাম! একবার ভাবতে পারিস সেই অনুভুতি টার কথা? আমার নাড়ীছেঁড়া ধনকে ১০দিন ১০ রাত পর প্রথম বারের মতো বুকে পেয়েছি, কোলে নিয়েছি! কিন্তু এটাই জীবনের শেষ নেওয়া! আর কোনদিন তুই আমার বুকে আসবিনা! আর কোনদিন তোকে কোলে নিতে পারবোনা! বুঝতে পারছিলাম না আমার তখন কাঁদা উচিত নাকি হাসা উচিত! সবাই খুব কান্না করছিলো! তোর দাদী, দাদা, নানুভাই, খালামনিরা সবাই খুব কাঁদছিলো! শুধু আমিই একটুও কাঁদতে পারিনি বাবা জানিস! অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তোকে দেখছিলাম! একটা পলকের জন্যে চোখটা বন্ধ করে তোকে দেখার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি! তোর পা দুটোকে মনেহচ্ছিলো আমার জান্নাত! তাই চুমো না দিয়ে থাকতে পারিনি!
পরের দিন…. সাদা কাফনে তোকে জড়িয়ে শেষবারের মতো আমার সামনে আনা হলো! বিশ্বাস কর সোনা! আমি তখনো কাঁদতে পারিনি! এতো সুন্দর লাগছিলো তোকে! কি বলে তোকে চির বিদায় দিবো বুঝতে পারছিলাম না! তোর কপালে আর পা দুটোতে চুমু দিয়ে বলেছিলাম…..বাবা, আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কোন কষ্ট দিতে চাইনি! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও! তোমার রবের কাছে আমার আর তোমার বাবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো! জান্নাতে যেন আমাকে আর তোমার বাবাকে তোমার সাথে মিলিত হওয়ার অনুমতি তিনি দেন! আল্লাহ হাফেজ”।