banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 198 বার পঠিত

 

প্রসূতি মায়েদের আপন হয়ে ওঠা এক ক্লিনিকের গল্প

হবিগঞ্জ:  মাত্র বছর দুয়েক পূর্বেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকতো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি । নাম মাত্র স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হতো কেন্দ্রটি থেকে। অন্য রোগীদের মতো প্রসূতিরাও ছুটে যেতেন  শহরের দিকে। কিন্তু বদলে গেছে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সেবা। প্রসূতি সেবাদানে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি আজ এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।

আলোচিত এই সেবা প্রতিষ্ঠানটি হলো হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। যেটি এখন শুধুই স্বাস্থ্য কেন্দ্র নয়, প্রসূতিদের কাছে নিরাপদ সন্তান প্রসবের এক আপন ঠিকানা। অল্প দিনে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে। এখানে দিনে রাতে ২৪ ঘন্টা প্রসূতি মায়েরা আসেন নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য। পরিছন্ন পরিবেশে বিনা খরচে সন্তান প্রসব শেষে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে যান তারা। তাই এখন শুধু বহরা ইউনিয়নের প্রসূতিরাই নন, আশে পাশের ইউনিয়ন এবং উপজেলার প্রসূতিরাও আসেন এখানে সেবা নিতে।

পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক আহছানুল হক সুমন জানান, এক মাসে ১৭ শিশুর জন্মগ্রহণের সর্ব্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। হঠাৎ কীভাবে কার উদ্যোগে বদলে গেল স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির চিত্র?

সেই মানুষটি হলেন বহরা ইউনিয়ন পরিষদেরই চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন। বদলে যাওয়ার কথা চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন জানালেন, এর আগেও একবার তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখনও এই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি এখানে ছিল কিন্তু সেবা কার্যক্রম নিয়ে তখন তিনি ততটা ভাবেননি। সর্বশেষ গত ইউপি নির্বাচনে তিনি আবার চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ইউএসআইডি এর অর্থায়নে মা-মণি সীমান্তিক এর একটি  প্রকল্পের অধীনে এক কর্মশালায় যোগদান করার সুযোগ পান। ওই কর্মশালায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ করে নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে যেসব আলোচনা হয়, তাতে তিনি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হন।

সিদ্ধান্ত নেন নিজের ইউনিয়নে অবহেলায় পড়ে থাকা স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিকে সেবাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার। তিনি জানান, কর্মশালা ঘিরে পরিষদের সদস্যদের তার আগ্রহের কথা তুলে ধরলে তাঁরাও উৎসাহী হন। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি মাধবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোঃ শাহজাহান ও স্বাস্থ্য সেবায় সহযোগী ওই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতা চান তিনি। তারা সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। মা-মণি সীমান্তিকের পক্ষ থেকে রুবিয়া খাতুন নামের একজন প্যারামেডিক দেওয়া হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মাহমুদা খাতুন, পরিবার পরিকল্পানা পরিদর্শক আহছানুল হক সুমন সহ কিছুসংখ্যক জনবল নিয়ে প্রথম দিকে কার্যক্রম শুরু হয়। ১টি বেড(সিট) দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও এখন বেড সিটের সংখ্যা ৩টি।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে  ঢুকতেই চোখে পড়ে আশে পাশের পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। ভেতরে ঢোকার পরে দেখা যায় সামনে খোলা মেলা বারান্দায় ৭-৮জন নারী। কারও কারও সঙ্গে আছেন পুরুষও । তাদের প্রত্যেকের কোলে বিভিন্ন বয়সের শিশু। কারও কোলে নবজাতক। এরই মধ্যে ভেতরের একটি কক্ষ থেকে ভেসে আসে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ। কয়েক মিনিট পর কর্তব্যরত সেবিকা মাহমুদা আক্তার হাসতে হাসতে এগিয়ে আসেন নতুন তোয়ালে মোড়ানো ওই নবজাতককে কোলে। জানান দুইটা জমজ শিশু পৃথিবীর আলো দেখল দুজনই সুস্থ আছে।

কেমন লাগছে জানতে চাইলে সেবিকা মাহমুদা বলেন, অনেক ভালো। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান সুস্থ্যভাবে দুনিয়ায় এলে মা যেমন সব কষ্ট ভুলে যান, তেমনি আমাদের কাছেও খুব ভালো লাগে।

সেবা গ্রহণকারীদের বক্তব্য

উপজেলার বহরা ইউনিয়নের হরিপশাদপুরের তাছলিমা আক্তার জানান, গত কিছু দিন পূর্বে উপজেলা সদরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে তাকে নিয়ে গেলে একজন নারী চিকিৎসক বলেন গর্ভের বাচ্চা নাকি উপরে উঠে গেছে দ্রুত অস্ত্রেপাচার করতে হবে। তিনি দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফেরেন পরদিন লোকমুখে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কথা শুনে এখানে আসেন। এখানে বিনা অস্ত্রপাচারে তার একটি ছেলে সন্তান প্রসব হয়। শুধু তাছলিমাই নন, সেবা নিতে আসা একই ইউনিয়নের শরিফা খাতুন, পলি আক্তার স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে বিনা অস্ত্রোপাচারে নিয়মিত সন্তান প্রসব করানোর কথা বলেন।

পরিবার কল্যাণ পরির্দশিকা মাহমুদা আক্তার জানান, পুরো ইউনিয়নের গর্ভবতী মায়েদের তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। পরিবার পরিকল্পানা পরিদর্শক আহছানুল হক সুমন বলেন, মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী মায়েদের নাম ঠিকানা ও মুঠোফোন নাম্বার নিয়ে আসেন। এর মাসিক বৈঠকে ওয়ার্ড ও গ্রাম ভিত্তিক গর্ভবতী মায়েদের আলাদা দুটি মানচিত্র তৈরি করা হয়। এসব সার্বক্ষনিক তদারক করেন ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন।

মাধবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ মোঃ শাহজাহান বহরা ইউনিয়নে অবহিতকরণ সভায় উপস্থিত থেকে প্রতিটি গর্ভবতী মাকে প্রসূতি সেবা নিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করছেন। উপজেলার বহরা ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি প্রসূতি সেবায় মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। গত ৮ মাসে এ কেন্দ্রে ১০৩ জন মা নিরাপদ প্রসব করেছে।

২৪ ঘন্টা ক্লান্তিবিহীন সেবা

স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের সামনে আশে পাশের বাজারে সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, এখানে ২৪ ঘন্টা নরমাল ডেলিভারি করা হয়। সাইনবোর্ডের লেখা অনুযায়ী সেবা দানে কোন হেরফের হয়না। অনেক সময় গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে সন্তান প্রসব করাতে হয় বলে জানালেন মা-মনি প্যারামেডিক রুবিয়া খাতুন।

বহরা ইউপি চেয়ারম্যান আলা উদ্দিন জানালেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবা কেন্দ্রটির জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা পরিষদ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছেন। তবে তার ইচ্ছা একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা।

মাধবপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আকিব উদ্দিন বলেন, বহরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ  কেন্দ্রটি সারা দেশের জন্য একটি মডেল হিসাবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাও এরই মধ্যে এ সফলতা দেখে গেছেন। একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইচ্ছে করলে কী না করতে পারেন আলাউদ্দিন সাহেব তার এ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মাধবপুর উপজেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সেবা পর্যবেক্ষন করেছেন সেইভ দি চিলড্রেনের কান্ট্রিডিরেক্টর এলিজাবেধ পির্য়াস, সাবেক স্বাস্থ্য সচিব হুমায়ুন কবীর, মি: জবি জর্জ সিওপি এমসিএইচ আইপি, মিস কান্তা জামিল, মিস সিনো কুনিয়া, ডা: জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া উপ-পরিচালক পরিবার পরিকল্পনা হবিগঞ্জ, ডাঃ দেবপ্রদ রায়, সিভিল সার্জন হবিগঞ্জ এর নেতৃত্বে একাধিক প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

Facebook Comments