বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পেশাদার নারী সাহিত্যিক আফরা বেন (Aphra Behn) বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর রচিত নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও অনুবাদ সাহিত্যের কারণে। ইংল্যান্ডের ক্যান্টাবেরির কাছে ১৬৪০ সালের ১৪ ডিসেম্বরে জন্মেছিলেন তিনি। এখনকার সময়ের চেয়েও পিছিয়ে থাকা সময়ে নারী হয়ে তিনি লিখেছিলেন তৎকালীন সমাজের রূঢ় বাস্তবতাগুলো নিয়ে। জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁর লেখায় সমাজ সচেতনতা, লিঙ্গসমতা ও বর্ণবাদ বিরোধিতা তাঁকে সাহিত্যজগতে করে তুলেছে অনন্য। নিজেকে একজন পেশাদার লেখক হিসেবে তিনি দাবি করতেন। শুধু লেখালেখি করেই তিনি স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন ওই সময়ে। সে হিসেবে পৃথিবীর প্রথম পেশাদার নারী লেখক হিসেবে তাঁকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আফরা বেনের জনপ্রিয় একটি উপন্যাস ‘অরুনোকো’ (Oroonoko), যেটিকে আজও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে ১৬৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি।
আফ্রিকার সুরিনাম দেশের রাজপুত্র অরুনোকোর দাস মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনী নিয়েই এই উপন্যাস। অরুনোকোর কাহিনী ছিল অনেকটা এমন :
অরুনোকোর পিতামহ (দাদা) ছিল আফ্রিকার একটি সম্প্রদায়ের রাজা। প্রচণ্ড লোভী ও বর্বর এই রাজার ছিল অনেক পত্নী-উপপত্নী ও সেবা দাসী। অরুনোকো ভালোবেসেছিল ইমোইন্ডাকে, গোপনে বিয়েও করেছিল তারা। কিন্তু অরুনোকোর দুশ্চরিত্র দাদা ইমোইন্ডাকে বিয়ে করতে চায়। তাতে রাজি না হওয়ায় জোর করে ইমোইন্ডাকে বানায় তার সেবাদাসী।
তবুও অরুনোকো আর ইমোইন্ডার প্রেম বাধা মানে না। একদিন ধরা পড়ে যায় ওরা। রাজা ইমোইন্ডাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বেঁচে দেয় জঙ্গলে আর অরুনোকোকেও ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রি করে দেয়। অনেক জায়গায় হাতবদল হয়ে অরুনোকো একদিন সেই জঙ্গলেই নির্বাসিত হয়ে ফিরে আসে, যেখানে তার প্রেমিকা ইমোইন্ডা আছে।
আবার মিলন ঘটে অরুনোকো আর ইমোইন্ডার। সেখানে তারা নিয়মিত মিলিত হতে থাকে। ফলে ইমোইন্ডা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। নিরাপদ প্রসবের জন্য অরুনোকো ইমোইন্ডাকে দেশে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এই আবেদন নাকচ করে দেয় ব্রিটিশ দাস মালিক ট্রেফরি ও ডেপুটি গভর্নর বিয়াম। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে অরুনোকো। অন্যান্য ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে মালিকের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। সেই যুদ্ধে ক্রীতদাসরা পরাস্ত হয়। ইংরেজ ডেপুটি গভর্নর বিয়াম অরুনোকোর ওপর বর্বরতম নির্যাতন চালায়। তারপর শর্ত চাপিয়ে তাকে মুক্তি দেয়।
মুক্তি পেয়ে বিদ্রোহী অরুনোকো বিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নেয়। সেই যুদ্ধে তার মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। তার মৃত্যুতে স্ত্রী ইমোইন্ডার জীবনে যে অপমান নেমে আসবে, তা থেকে মুক্তি দিতে স্ত্রীর সম্মতিতে যুদ্ধের আগেই অরুনোকো ইমোইন্ডাকে হত্যা করে। কিন্তু বিয়ামকে মারতে পারে না অরুনোকো। বন্দি অরুনোকোকে মেরে রক্তাক্ত করে তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে সর্দারদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যোদ্ধা অরুনোকো যেন রোমের দাস বিদ্রোহের কিংবদন্তি নেতা স্পার্টাকাসেরই উত্তরসূরি। একই সঙ্গে অরুনোকো আমাদের সামনে একজন প্রেমিক ও স্বামীর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যে তার স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে।
আফরা বেনের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তথ্য খুবই কম, নির্ভরযোগ্য তথ্য আরো কম। পৈতৃক নাম আফরা জনসন। তাঁর শৈশব-কৈশোরের সময়টা ছিল ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের সংকটকাল, যাকে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের কাল হিসেবে ধরা হয়।
ধারণা করা হয়, তিনি ১৬৬৩-৬৪ সালের দিকে আফ্রিকার সুরিনামে ছিলেন। আর সেখানেই তিনি অরুনোকোর কাহিনী বর্ণনাকারীর দেখা পান। ১৬৬৪ সালে লন্ডনে ফিরে তিনি মিস্টার বেন নামের এক বণিককে বিয়ে করেন। মিস্টার বেন ১৬৬৫ সালে মারা যান। তবে অনেকে মনে করেন, লেখিকা আত্মরক্ষার স্বার্থে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করতেন, বাস্তবে তিনি বিয়েই করেননি।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সুনজরে থাকায় কিছুদিন তিনি ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন। বিনা বেতনের চর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অনেক দেনা করে ফেলেন লেখিকা, ফলে ঋণের দায়ে তাকে জেলখানায় কাজ করতে হয়েছিল। এর পর তিনি গুপ্তচরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে নাটকে মনোনিবেশ করেন।
তাঁর প্রথম নাটক ছিল ‘দ্য ফোর্সড ম্যারেজ’ (১৬৭০), যা তাঁকে খ্যাতি ও অর্থ, দুই-ই এনে দেয়। ১৬৭১ সালে করেন ‘দি আমোরাস প্রিন্স’। এরপর একে একে ‘দ্য ডাচ লাভার’ (১৬৭৩), ‘আবদেলাজার’ (১৬৭৬), ‘দ্য টাউন ফপ’ (১৬৭৬), ‘দ্য ডেবাউচে’ (১৬৭৭), ‘দ্য কাউন্টার ফিট ব্রাইডগ্রুম’সহ (১৬৭৭) বেশ কয়েকটি সফল নাটক রচনা করেন।
ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে (১৬৭৯-৮১) সেই সংকট নিয়ে মন্তব্য করার কারণে আফরা বেনকে আইনি হাঙ্গামা পোহাতে হয়।
আফরা বেনের সবচেয়ে সফল নাটক ছিল ১৬৭৭ সালে মঞ্চস্থ করা ‘দ্য রোভার’। ‘দ্য রোভার’-এর দ্বিতীয় অংশ মঞ্চস্থ করা হয় ১৬৮১ সালে। তাঁর অনেক নাটকেই যৌন বিষয় উপস্থাপনের কারণে সমসাময়িক সময়ে তিনি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
তাঁর কবিতার বইয়ের মধ্যে ‘পোয়েমস আপন সেভারেল অকেশনস’ (১৬৮৪), ‘লাভ লেটারস বিটউইন এ নোবেল ম্যান অ্যান্ড হিজ সিস্টার’, ‘দি আমোরস অব ফিল্যান্ডার অ্যান্ড সিলভিয়া’ (১৬৮৭) উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যুর আগে তিনি রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ভুগেছিলেন। ১৬৮৯ সালের ১৬ এপ্রিলে লেখিকা মারা যান। তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।