banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 500 বার পঠিত

 

প্যারেন্টিং প্ল্যান


কানিজ ফাতিমা


একটি শিশুর ভালোভাবে গড়ে উঠার প্রয়োজন শুধুমাত্র বাবা-মায়ের মানসিক শান্তি আর পরিবারের সুখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজ এবং সভ্যতারও মূল ভিত্তি। পূর্বের অধ্যায়গুলোতে আমরা শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারনের গুরুত্ব এবং পিতামাতাদের যেসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই সতর্ক থাকতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ে আমরা কিছু বহুল প্রচলিত ভুলধারনা তুলে ধরবো, সেই সাথে এমন কিছু “ফাঁদ” নিয়েও আলোচনা করব যেগুলোতে পিতামাতারা সহজেই পরতে পারেন। এখানে আরো থাকবে কিভাবে এ ফাঁদগুলো এড়িয়ে চলা যায় সে বিষয়ে আলোচনা । সবশেষে থাকবে প্রচলিত কিছু জনশ্রুতি (Myth) এবং তার খন্ডন । এসব ভুল ধারনাগুলো তুলে ধরার কারন হচ্ছে, প্যারেন্টিংএ কি কি বাধা আসতে পারে তা সম্পর্কে পিতা-মাতাদের সচেতনত করা । কারণ প্যারেন্টিং এর চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আগে থেকেই ভালো ধারণা ছাড়া একটি ভালো প্যারেন্টিং প্ল্যান কখনোই সম্ভব হয়না।

প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করা ও গুপ্ত ফাঁদগুলো সম্পর্কে সচেতন করা

উত্তারিধকারসূত্রে প্রাপ্ত প্যারেন্টিং পদ্ধতিগুলোর অন্ধ অনুসরন

অনেকসময়ই আমরা আমাদের আচরণগত অভ্যাসগুলো আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে অর্জন করি। এইগুলো যে সবসময় কার্যকর বা সর্বোত্তম তা কিন্তু নয়। বরং অনেক সময়ই দেখা যায় এদের অনেকগুলোই ঠিক যুগোপযোগী নয়, এমনকি কোনো কোনটি অনেকক্ষেত্রে ক্ষতিকরও বটে। একজন মা বলেছিলেন, “যে মুহূর্তে আমি গর্ভবতী হলাম, সে মুহূর্ত থেকে আমি আমার মা এর মত হয়ে গেলাম ”। কিছু মা-বাবা, বিনয় আর কৃতজ্ঞতা থেকে ঘোষণা করে দেন যে তাদের বাবা-মা তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে বড় করেছেন। একথা সত্যি যে, আমাদের সবারই আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক বেশি আদর-ভালোবাসা পাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু তাদের সবারই যে ইতিবাচক প্যারেন্টিং সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বা দক্ষতা ছিল- তা কিন্তু বলা যাবে না।

অপরের অন্ধ অনুকরন

অন্য কোনো পিতা-মাতার পুরোপুরি অন্ধ অনুকরন প্যারেন্টিং এর সঠিক পদ্ধতি হতে পারেনা। মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশুরই নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব থাকে যা অন্য বাচ্চার থেকে ভিন্ন । তাই এক বাচ্চার জন্য যা ভালো তা অন্য বাচ্চার জন্য ভালো নাও হতে পারে। মা-বাবার উচিত তাদের সন্তানকে ভালো ভাবে জানা ও সেই সন্তানের জন্য কোনটা ভালো তা খুঁজে বের করা। অন্য পিতা-মাতাদের পরামর্শ নেয়া অবশ্যই জরুরী তবে এ সময় মনে রাখতে হবে যে প্যারেন্টিং এর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে , ক্ষেত্র বিশেষে এসব পদ্ধতির কার্যকারীতা পরিবির্তিত হয়, অর্থাত একেক ক্ষেত্রে একেক পদ্ধতি বেশী কার্যকর। যেমন, অনেক পিতামাতা সন্তানদের সাথে বেশ নমনীয় আর উদার থাকেন, আবার কেউ হয়তো সন্তানদের বেলায় কঠোরতা অবলম্বন করতে পছন্দ করেন।

প্রতি পদক্ষেপেই নতুন চমক

“ নতুন বাবারা দ্রুতই বুঝে যান যে সন্তান মানুষ করা কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই ক্রমাগত উদ্ভাবনের এক মরীয়া প্রয়াস। ” (Bill Cosby,, অভিনেতা)
“প্যারেন্টিং এমন বিষয় যে আমরা শিখে নিয়ে তারপর শুরু করি, বরং এটা শুরু হওয়ার করতে করতে শিখি” (ELKIND,১৯৯৫)

সন্তানের মাধ্যমে নিজের অপূর্ণ ইচ্ছার পূর্ণতা

সন্তানের মাধ্যমে নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি ভুল প্যারেন্টিং আচরন। এমন অনেক বাবা-মাই আছেন যারা নিজেদের সন্তানদের মাধ্যমে নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরন করার চেষ্টা করেন। এমনকি অনেক সময় সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতি তোয়াক্কা না করেই তাদের উপর নিজেদের পছন্দ চাপিয়ে দেন। যেমন, আমরা অনেককে দেখি নিজেরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি; ফলে সেই অপূর্ণতা থেকে সন্তানদের বাধ্য করেন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। আমাদের মনে রাখা উচিত, সন্তান কখনোই বাবা-মার সংযোজন নয়।

সন্তানদের নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা অনিচ্ছা রয়েছে।

বাবা-মায়েরা অনেক সময় সন্তানদের নিজেদের একটি বর্ধিত অংশ ভাবতে পছন্দ করেন। তাই তারা নিজেদের অপূর্ণতা গুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চান, নিজেদের ভুলগুলো সন্তানদের মাধ্যমে শুধরে নিতে চান, এমনকি তাদের নিজেদের বাবা-মায়ের প্রতি করা অতীতের ভুলগুলোও নিজের সন্তানের মাধ্যমে শুধরাতে চান। যদি কোনো বাবা-মা খেলাধুলায় নিজের আকাঙ্খানুযায়ী ভাল না করতে পারেন, তারা চান তাদের সন্তানরা চ্যাম্পিয়ন হোক। যদি তারা অংক বা বিজ্ঞানে খারাপ করে থাকেন, তারা চান তাদের সন্তান আইন্সটাইন হোক। কেউ যদি রাজনীতিতে সফলতা না পান, তবে তারা চান তাদের সন্তান বড় রাজনীতিবিদ হোক । কিন্তু বাবা-মায়ের মনে রাখতে হবে, মাতৃত্ব বা পিতৃত্ব কখনোই দ্বিতীয় শৈশব নয়, আর সন্তানও মা-বাবার ক্ষুদ্র সংস্করণ নয়। জীবনের শুরু থেকেই সন্তানদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে এবং তাদের সেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করতে হবে।

পিতৃত্ব-মাতৃত্বের দ্বায়িত্বভার অন্যের কাঁধে অর্পন করা

অনেকে মনে করেন যে প্যারেন্টিং এর দায়িত্ব মা কিংবা বাবা একজনের পক্ষে পালন করা সম্ভব। সত্যিকার অর্থে, বাম হাত যেমন ডান হাতের বিকল্প হতে পারেনা আর ডান হাত যেমন বাম হাতের দায়িত্ব নিতে পারেনা, তেমনি মা বা বাবা কেউই একজন আরেকজনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন না। একটি সন্তানের বেড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মা দু’জনেরই নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দাদা-দাদী, নানা-নানী, অন্য কোনো আত্বীয়, বেবি সিটার বা কাজের বুয়া কেউই কখনোই বাবা-মায়ের স্থলাভিসিক্ত হতে পারেননা। তারা বাবা -মায়ের সাহায্যকারী হতে পারেন ঠিকই কিন্তু কখনোই মা-বাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিকল্প হতে পারেননা।

শিশুকে শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে বুঝানোকেই যথেষ্ট মনে করা

সন্তান ও পিতামাতার সম্পর্ক শুধুমাত্র যুক্তি নির্ভর সরল সমীকরণ নয়। মা-বাবা আর সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক একমাত্র যুক্তির উপর ভিত্তি করে হয়না, এই সমীকরণে অভ্যাস, আবেগ-অনুভুতিরও স্থান রয়েছে। যেমন ধরুন, কোনো মা-বাবা যদি সন্তানকে ফলমূল বা শাক-সবজি খেতে উদ্বুব্ধ করতে চান তাহলে, “খাও, এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, তোমার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন আর মিনারেল এই খাবারে রয়েছে” – এরকম যুক্তি দিলেই কাজ হয়ে যাবে এমনটা না, এক্ষেত্রে ভালবাসা-আবেগ ইত্যাদিরও প্রয়োগ করে তাকে বোঝাতে হবে । মনে রাখতে হবে যে যুক্তির প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই, কিন্তু শধুমাত্র যুক্তিই যথেষ্ট নয়।

Facebook Comments