কানিজ ফাতিমা:
প্যারেন্টিং শব্দটা আমরা খুব বেশী দিন হয়নি শুনছি। যদিও পৃথিবীর শুরু থেকেই বাবা মায়েরা সন্তাল লালন পালন করে আসছেন কিন্তু এটা যে শেখার মতন একটা বিষয় সেটা আমরা অনুধাবন করছি মাত্র কয়েক বছর হলো। আমরা বুঝতে পারছি অন্তত এই যুগে পারেন্টিংকে “এমনি এমনি ” হয়ে যাবার বিষয় হিসাবে ছেড়ে দেবার কোনো সুযোগ নাই। এটা আমাদের কাছে পরিস্কার যে ভালো ও যথাযথ প্যারেন্টিং এর জন্য দরকার দক্ষতা ও প্রস্তুতি। এর জন্য দরকার পড়াশুনা ও প্রাকটিস। শিশুদের লালন পলনে বাবা মায়েদের যা জানা দরকার একজন শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে তা আজ তুলে ধরার চেষ্টা করব। পারেন্টিং এর জন্য প্রথমেই যেটা বোঝা দরকার তা হলো আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠার পেছনে কোন শক্তি গুলো মূল প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। বর্তমান সময়ে বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা ৩ টি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল।
১. পারেন্টিং-বাবা-মা ও অন্যান্য অভিভাবকরা বাচ্চাকে কিভাবে বড় করছেন এবং তারা নিজেরা নিজেদের ভেতর কেমন পারস্পরিক আচরণ করছেন ।
২. স্কুল সিস্টেম – শিক্ষক-শিক্ষিকার মান ও চরিত্র, কারিকুলাম, বইসহ অনান্য লেখাপড়ার উপাদান, অভিভাবকদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দর্শন কেমন ।
৩. বন্ধু ও মিডিয়া – বাচ্চারা মিডিয়াতে কি দেখছে ও বন্ধুদের কি করতে দেখছে। এই প্রভাবক গুলা এতটাই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত (interrelated) যে প্রত্যেকটা প্রত্যেকটাকে প্রভাবিত করে। এই তিনটি উপাদান যদি পজিটিভ হয় তবে শিশুর বেড়ে উঠা সুসম হবে। তাই বাবা মায়েদের মনে রাখতে হবে পারেন্টিং এর পাশাপাশি অন্য দুটি প্রভাবককেও আমলে আনা জরুরী । এটাকে আমরা একটা ত্রিভূজের সাথে তুলনা করতে পারি -ত্রিভুজের উপরের চুড়াতে অবস্থান করেন বাবা মা।
কারণ একজন সচেতন বাবা-মা বাকী উপাদান দুটোকে অনেক বেশী প্রভাবিত করতে পারেন। যেমন ধরুন স্কুল সিস্টেমের ব্যাপারে, সচেতন বাবা মায়েরা শুধু স্কুলের সুনাম বিবেচনা না করে সুনামের পাশাপাশি স্কুলের মূল্যবোধ, শিক্ষকদের আচরণ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলোও বিবেচনা করবেন। শুধু স্কুলের কারিকুলামের বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্যান্য উপকারী বই বাচ্চাকে নিয়ে পড়বেন । বাসায় বাচ্চার জন্য ও নিজেদের জন্য ছোট করে হলেও লাইব্রেরী রাখবেন।
মনে করছেন, অনেক জায়গা লাগবে? একটা আলমারী এমনকি আপনার ড্রেসিং টেবিলের এক পাশকেও ব্যবহার করতে পারেন লাইব্রেরী হিসাবে। বাচ্চার স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা খুবই জরুরী। নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অনেক কিছুই আপনার চোখে পরার আগে শিক্ষকের চোখে পরে। প্যারেন্ট মিটিং এ নিয়মত যাওয়া বাব-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম। এভাবে বাবা মায়েরা স্কুল সিস্টেমের অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করতে পারে এবং বাচ্চার জন্য পসিটিভ হিসাবে নিশ্চিত করতে পারে।
বাচ্চার বন্ধু তৈরী করতে সক্রিয় ভুমিকা নিন। আপনার বাচ্চার বয়স যখন ৬.৭.৮.৯.১০ তখনি তার চারপাশ থেকে কে কে তার বন্ধু হতে পারে তা খেয়াল করুন। তাদের পরিবার সম্পর্কে খোজ নিন। তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে আপনারা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ুন – এভাবে নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনার সন্তান কেমন পরিবারের সন্তানের সঙ্গে মিশছে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত দিন , তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকুন। কৈশোরে ভুল বন্ধু বেছে নেবার ঝুকি এভাবে আপনি শৈশবেই কমিয়ে ফেলতে পারেন। মিডিয়ার ব্যাপারে নিজে সচেতন হন। নিজে এমন কিছু দেখবেননা যা আপনি চাননা আপনার বাচ্চা করুক। টিভি চানেলে ভালো কিছু না থাকলে youtube থেকে ভালো জিনিস ডাউনলোড করে রাখুন , পরে বাচ্চাকে নিয়ে দেখুন।
সপ্তাহে একদিন মুভি নাইট করতে পারেন – মুভে দেখার পর এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা একটি ভালো শিক্ষনীয় ব্যাপার। এতে বাচ্চরা মিডিয়ার সবকিছুকেই যে প্রশ্নাতীত ভাবে বিশ্বাস করতে হয়না সেটা শিকে যায়।
সর্বশেষ মনে রখবেন পারেন্টিং এর কোনো সর্টকাট রাস্তা নেই। বাচাকে প্রচুর সময় দেয়া এবং তাকে নিয়ে বিরামহীন পরিকল্পনা করাই নিশ্চিত করবে আপনি কতটা ভালোভাবে বাচ্চাকে মানুষ করছেন। আজ ব্যস্ততার অজুহাতে যা অবহেলা করবেন কাল হয়ত তা হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে যাবে। সময়ে এক ফোড়ে যা হবে অসময়ে দশফোড় দিয়েও হয়তো তা সম্ভব হবে না।