banner

বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 701 বার পঠিত

 

পীরের ‌তরিকা কী ও কেন?

এভাবেই পীর ও মুরিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং চেষ্টা-সাধনার মধ্য দিয়ে উভয়েই আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দায় রূপান্তরিত হবেন। পীর হবেন তার সৎপথ প্রদর্শনের অশেষ সওয়াব পেয়ে, আর মুরিদ হবেন সঠিক পথে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে
মুসলমানদের আধ্যাত্ম সাধনার নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতিকে তরিকা বলে। আধ্যাত্ম সাধনারত ব্যক্তিকে তরিকতপন্থী বা সালেক বলে। শরিয়ত অনুযায়ী আমল করার যেমন মাজহাব, আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য তেমনি তরিকা। আন্তরিকতার সঙ্গে শরিয়ত অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করে প্রজ্ঞাবান হওয়াই তরিকতের উদ্দেশ্য। কোরআন-হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত শরিয়তের আমল যথা- নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত ইত্যাদি প্রতিপালনের পাশাপাশি জিকির-ফিকির, ধ্যান, সৎসঙ্গ, কুরিপু দমন এবং সৎ স্বভাব ইত্যাদি যেমন কার্যাবলি প্রতিপালনের দ্বারা একজন ব্যক্তি নিজেকে পরিপূর্ণ ঈমানদার এবং মানবীয় গুণাবলির দ্বারা ভূষিত করতে পারে। এ সাধনায় অগ্রসর ব্যক্তি মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। সে ইহ এবং পারলৌকিক জীবনে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর অফুরন্ত নেয়ামত দ্বারাও সিক্ত হয়। জান্নাতি এ নেয়ামতরাজির আকর্ষণে মানুষ তরিকতপন্থী হতে ছুটে আসে আধ্যাত্মিক জগতের শিক্ষক সুফি, দরবেশ, পীর এবং মুরশিদের কাছে। এ পথে যিনি যতটুকু অগ্রসর হন, তার স্প্রিহা তত বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা দুনিয়াবিমুখ হয়ে মহান প্রভু এবং রাসূল (সা.) এর প্রেমে মাতোয়ারা আশেকি জীবন যাপনে ব্রতি হন।

বাংলাদেশে আধ্যাত্ম সাধনার এ ভুবনে হক্কানি পীর যেমন আছেন, তেমনি আছে বহু বাতিল ও বেশরা পীর-ফকির। তাদের খপ্পরে পড়ে মানুষ যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি জান্নাত লাভের আশায় এসে ঈমানে দৌলতটুকু শিরকের সঙ্গে মিশ্রিত করে দোজখি হয়ে যাচ্ছে। তাই তরিকতপন্থী হওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। কার থেকে আমি তরিকা গ্রহণ করছি? তিনি সত্যিকারভাবে কামিল কিনা? আমাকে আল্লাহর সান্নিধ্যের দিকে পথ প্রদর্শনের যোগ্যতা তার আছে কিনা? এসব বিষয় নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েই শুধু তরিকা লাভের জন্য তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করা যেতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে, পীর ধরতে হবে অধ্যাত্মিক সাধনার পথে ব্রতি হওয়ার জন্য। কোনোভাবে দুনিয়াবি স্বার্থে মুরিদ হওয়া সম্পূর্ণভাবে নাজায়েজ। তদ্রুপ যিনি মুরিদ করবেন, তিনিও নিছক আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথের দিশা দিতেই সচেষ্ট থাকবেন। কোনো ধরনের দুনিয়াবি গরজ তার মধ্যে থাকবে না। এভাবেই পীর ও মুরিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং চেষ্টা-সাধনার মধ্য দিয়ে উভয়েই আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দায় রূপান্তরিত হবেন। পীর হবেন তার সৎপথ প্রদর্শনের অশেষ সওয়াব পেয়ে, আর মুরিদ হবেন সঠিক পথে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে।

শরিয়তের ওপর আমলের জন্য আগে অনেক মাজহাব থাকলেও কালের আবর্তে তা চারটি মাজহাবে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তদ্রুপ তরিকতের ভুবনে বহু তরিকার সন্ধান পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা প্রসিদ্ধ চারজন বিখ্যাত পীরের নামে প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া, কাদেরিয়া, মোজাদ্দেদিয়া ও নকশবন্দিয়া তরিকা নামে বিশেষ করে ভারতবর্ষে সীমিত হয়ে গেছে। তরিকতপন্থী কোনো ব্যক্তি মাত্র একটি তরিকার সবক যথাযথভাবে আদায় করে কামালিয়াতের স্তরে উপনীত হতে পারেন। একাধিক তরিকার সবক সম্পন্ন করতে পারলে তা আরো ভালো। তবে যেহেতু তরিকতের এ অঙ্গন সম্পূর্ণরূপে অনুভূতিনির্ভর ও লোকচক্ষুর অন্তরালের বিষয়। এর কোনো কিছুই প্রকাশযোগ্য নয়। তাই এ পথের পথিকমাত্রই সর্বদা নিজেকে আড়াল করে রাখতে পছন্দ করেন। এ পথে যা কিছু অর্জন হয়, তা নিতান্তই আখেরাতের ও একান্তভাবে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির গোপন অভিসার মাত্র। তারা নির্জনে রাতের আঁধারে প্রভুর কুদরতি কদমে লুটিয়ে পড়ে রোনাজারি করে আপন অপরাধ ও অক্ষমতার বিষয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। দুনিয়ার যতবড় ক্ষতি হোক অথবা দুনিয়া তার পদতলে গড়াগড়ি খেলেও তার মধ্যে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। প্রেমানলে দগ্ধ অতৃপ্ত হাহুতাশপূর্ণ আন্তরিক অবস্থায় তার জীবন কাটে।

ড. সৈয়দ মুহা. শরাফত আলী
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান

Facebook Comments