তাপসী রাবেয়া বড় হয়েছেন ঢাকা শহরে। কিন্তু বিয়ে হলো নিভৃত গ্রামে। বাড়িটাও মাটির। এটা দেখে তাঁর মন খারাপ হয়নি। হয়েছিল গ্রামের মেয়েদের দেখে। তারা শহরের মেয়েদের দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বলে, শহরের মেয়েরা কী সুন্দর! তাপসী ভাবেন গ্রামের মেয়েরাও সুন্দর। কিন্তু তারা নিজের সৌন্দর্য হয়তো সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। এই মেয়েদের কথা ভেবে তিনি নিভৃত গ্রামের এই মাটির বাড়িতে একটি বিউটি পারলার গড়ে তুললেন। একে একে গ্রামের মেয়েরাও বিউটি পারলারে আসতে লাগল। খবর রটে গেল এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। এখন ১৫-২০টি গ্রামের মেয়েরা প্রতিনিয়ত আসে বিউটি পারলারে। শুধু তারা সাজতে আসছে তা-ই নয়, আসছে কাজ শিখতেও।
মাটির বাড়ির বিউটি পারলার
গ্রামটির নাম কালিগ্রাম। এটি নওগাঁর মান্দা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবিস্থত। সম্প্রতি গ্রামের রাস্তাটা পাকা হলেও মানুষের বাড়িঘর এখনো মাটিরই রয়ে গেছে। এই গ্রামেই ১৯৯৭ সালে বউ হয়ে আসেন তাপসী রাবেয়া। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা হলেও তাঁর জন্ম ঢাকা শহরে। বড় হয়েছেন ঢাকাতেই। শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেন, মাটির রাস্তা, মাটির ঘরবাড়ি। মানুষগুলো যেন মাটির মতন। শহরের মেয়েদের সাজ দেখে তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় তাঁর মাথায় বিউটি পারলারের ভাবনা আসে। কিন্তু কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারেন না। অবশেষে ২০১১ সালে তিনি ঢাকায় গিয়ে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিলেন। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে কাজটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারলেন না। অনেকেই নিরুত্সাহিত করলেন। গাঁয়ে এটা চলবে না। শুধুই টাকা নষ্ট হবে। কিন্তু তাঁর মন মানে না। ২০১৩ সালে আবারও ঢাকায় কিছুদিন থেকে প্রশিক্ষণ নিলেন। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন কাজটা তিনি শুরু করবেনই। কিন্তু টাকার দরকার প্রায় দেড় লাখ। নিজের কিছু ছিল। ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা নিলেন। তাও হলো না। শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিলেন।
অবশেষে ২০১৪ সালের শুরুতে যাত্রা শুরু হলো ‘নবরূপা বিউটি পার্লার’-এর। গ্রামের বাড়িঘর যেহেতু মাটির। তিনি মাটির ঘরেই আয়োজন করলেন। মাটির ঘরটা সুন্দর করে রং করে নিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামের মেয়েদের সাজ বদলে যেতে থাকল। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল পাশের গ্রামগুলোতে। পর্যায়ক্রমে কালিগ্রাম থেকে শুরু করে উপজেলার কির্ত্তুলী, দেলুয়াবাড়ী, মহানগর, চৌবাড়িয়া, সাবাইহাট, কেশরহাট কামারপাড়া, কুসুম্বা, গাইহালা, কালীনগরসহ প্রায় ২০টি গ্রামের মেয়েরা আসতে শুরু করে।
সম্প্রতি রাজশাহী শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত কালিগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একটি দ্বিতল মাটির বাড়ি ঠিক ইটের বাড়ির মতো রং করা হয়েছে। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রঙিন এই মাটির বাড়িটি যে কারও নজর কেড়ে নেবে। দূর থেকেই এই সাইনবোর্ড চোখে পড়বে ‘নবরূপা বিউটি পার্লার’। মাটির দেয়ালেই লেখা রয়েছে ‘এখানে অভিজ্ঞ বিউটিশিয়ানদের দ্বারা বউ সাজানো, ভ্রুপ্লাক, ফেসিয়াল, ম্যানিকিওর, পেডিকিওর, হেয়ার রিবন্ডিং, চুল কাটা, চুল কালার করা এবং মেশিন দ্বারা নাক-কান ফোঁড়ানোসহ মেয়েদের যাবতীয় রূপচর্চার কাজ করা হয়।’
কাজও শিখছে মেয়েরা
তাপসী রাবেয়া বললেন, তাঁর বিউটি পারলারের কারণে গ্রামের মেয়েরাও এখন সৌন্দর্য সচেতন হয়ে উঠেছে। শুধু বিয়ের সাজ নয়, নিয়মিত স্কুল-কলেজের মেয়েরা পারলারে আসছে। তিনি বলেন, তাঁর কাজ দেখে উত্সাহী হয়ে গ্রামের কিছু মেয়ে সারা দিন পারলারে এসে পড়ে থাকত। একপর্যায়ে তারা দেখতে দেখতে কাজ শিখে যায়। এদিকে তাঁর পারলারের গল্প যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কাজের চাপও বেড়ে যায়। তখন তিনি এই মেয়েদের পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। তাদের মাসে ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেন। সব সময় দুজন মেয়েকে তাঁর সহকারী হিসেবে রাখতে হয়। এই মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কাজ করে। ইতিমধ্যে সাতজন তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখেছেন। তাঁদের কারও কারও বিয়ে হয়েছে। কেউ উচ্চতর পড়াশোনা করছেন।
পারলারে গিয়ে সহকারী শ্যামলী আক্তারকে পাওয়া গেল। তিনি স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। তিনি বলেন, তাঁরও ইচ্ছে রয়েছে বিয়ের পরে পরিবেশ পেলে এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন।
দেখা গেল সকালে চারজন মেয়ে এসে ফেসিয়াল করার জন্য বসে রয়েছে। তারা সবাই পার্শ্ববর্তী মহানগর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে রিয়া খাতুন জানায়, তারা এখন পারলারের নিয়মিত মুখ। তাদের আর পারলার ছাড়া চলে না।
এই পারলার থেকে বিয়ের সাজ করেছিলেন পাকুড়িয়া গ্রামের বৃষ্টি খাতুন। মুঠোফোনে কথা হয় বৃষ্টির সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনি নিয়মিত ওই পারলারে যেতেন। তাদের কাজের মান ভালো। গ্রামের ভেতরে হলেও উপজেলা সদরের চেয়ে তাদের কাজ ভালো। তাঁর বিয়ের সাজের সবাই প্রশংসা করেছে।
আসার সময় তাপসী রাবেয়া মজা করেই জানালেন, তিনি তাঁর ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দিয়েছেন। তাঁর কিন্তু আর কোনো ধারদেনা নেই।