banner

শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 236 বার পঠিত

 

পরিবারেও নারী-পুরুষের সমান সুযোগ থাকা জরুরি

সম্প্রতি একটি গোলটেবিল বৈঠকে কারখানার সুযোগ-সুবিধা-মান (কমপ্লায়েন্স) সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স’-এর কথা উল্লেখ করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। এই ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টি কী—তা জানিয়েছেন নাজনীন আহমেদ। ২১ আগস্ট ঢাকায় বিআইডিএস কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎ​কার নিয়েছেন মুসলিমা জাহান

ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টি কী?
নাজনীন আহমেদ:
 টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিল্পকারখানায় কমপ্লায়েন্স রাখা হয়। সেখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা যাতে মানসম্পন্ন পরিবেশে কাজ করতে পারেন সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়। তাঁদের বেতন, ছুটি, কর্মপরিবেশসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা থাকে। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও তা-ই। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স মানে একটি আদর্শ বা অধিকার-সচেতন পরিবার, যেখানে সব সদস্য নারী-পুরুষভেদে কারও অধিকার খর্ব না করে জীবনযাপনের সমান সুযোগ অর্জন করবেন। সর্বক্ষেত্রেই তাঁরা সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন, কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব হবে না। পরিবারের মধ্যে কোনো ধরনের প্রভুত্ব থাকবে না। সবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকবে।

আমাদের দেশে নারীরা কি পারিবারিকভাবে সম-অধিকার ভোগ করে থাকেন?
না. আ.:
 সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির কথা উল্লেখ থাকলেও সামাজিক ও ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি পরিবারে একজনকে কর্তা হিসেবে দেখা হয়। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই কর্তা হন একজন পুরুষ। আমাদের দেশে পরিবারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি চর্চা তো হয়-ই না, এমনকি বিষয়টি অপ্রয়োজনীয়ও মনে করা হয়। এ জন্য পরিবারে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যগুলো স্পষ্ট।

বৈষম্যগুলো কোথায়-কীভাবে ঘটে?
না. আ.:
 ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টির চর্চা হয় না বললেই চলে। পরিবারে যিনি গৃহিণী, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের; তিনি দিনরাত কায়িক-মানসিক পরিশ্রম করছেন। অথচ গৃহিণীদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। দেখা যায়, পুরুষ বাইরে কাজ শেষে এসে অবসর সময় কাটান। খুব বেশি হলে সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজ নেন। কিন্তু নারীকে বাইরের কাজ শেষ করে সন্তান পালনসহ ঘরের সব কাজ করতে হয়। নারীর কোনো অবসর বা ছুটি নেই। এমনকি ছুটির দিনেও ছুটি নেই।

খাবারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দিন শেষে নারী সবার পরে খাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় নারীরা বেশি অপুষ্টিতে ভুগছেন। তার মানে কি নারীরা এখানে উপেক্ষিত?ধনী পরিবারের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। আমরা খেয়াল করি না নারী সদস্য পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন কি না। তাঁর জন্য যথেষ্ট খাবার আছে কি না।

খাবারের বণ্টন থেকে শুরু করে সব বিষয়ে বৈষম্য আছে। দেখা যায় একই পরিবারের ছেলেকে ব্যবসার জন্য পুঁজি দেওয়া হলেও, মেয়েকে দেওয়া হয় না। হয়তো মেয়েটির উৎপাদনশীলতা বেশি। সে ব্যবসা করলে বেশি ভালো করতে পারত। এই বৈষম্য থাকলে তাকে আমরা আদর্শ পরিবার বলতে পারি না। এতে যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় না।

গৃহিণীর কাজের স্বীকৃতি বিষয়টি কীভাবে হতে পারে?
না. আ.: অনেকে মনে করেন গৃহিণীর কাজের স্বীকৃতি মানে জিডিপির অন্তর্ভুক্তীকরণ। আমি এর পক্ষপাতী নই। আমি চাই ঘরের কাজের একটি সামাজিক স্বীকৃতি থাকবে। একে ‘কাজ’ বলে মূল্যায়ন করা হবে। তবে এর অর্থনৈতিক মূল্যায়নও হতে পারে। একজন গৃহিণীর যে ছুটি দরকার, অবসর দরকার, সেটা দেখা হয় না। এই বিষয়গুলোতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

এ বিষয়টি গৃহকর্মীর জন্যও প্রযোজ্য। তাঁদের আমরা ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে বাধ্য করি। তিনি কখন ঘুমাবেন, কখন উঠবেন, তা-ও আমরা নির্ধারণ করে দিই। একজন মানুষ হিসেবে যে তাঁর ছুটি, বিনোদন, বা অবসরের দরকার আছে, তা ভাবিই না। এ বিষয়টি ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাঁরাও আমাদের পরিবারের অংশ।

পরিবারে সম-অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে? এ জন্য কি আইন করা প্রয়োজন?
না. আ.:
 সবকিছু ছকে বেঁধে বা আইন করে করতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। প্রথমত নারী-পুরুষভেদে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ জন্য আমরা যখন নারী অধিকার নিয়ে কথা বলব, তখন ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টি তুলে নিয়ে আসতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে হবে। সরকার নারী উন্নয়ননীতি বাস্তবায়নে অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, সেখানে ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে। বৃহৎ পরিসরে পরিবারে সম-অধিকারের বিষয়টি আলোচিত হলে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। তা ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিজ্ঞাপন, নাটকের মাধ্যমেও এই বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করা যায়।

কখন বোঝা যাবে পরিবারের মধ্যে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে?
না. আ.:
 সমাজ থেকে মানুষের সুখী হওয়ার হার কমে যাচ্ছে। তার বড় একটি কারণ পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব। পরিবারে হয়তো সহিংসতা নেই। কিন্তু শান্তি নেই। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স থাকলে এই সমস্যা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে। তখন পরিবারের সবাই সম-অধিকার ভোগ করতে পারবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমান সুযোগ পাবে। যে যে বিষয়ে পারদর্শী, সেখানে মতামত দিতে পারবে। পারস্পরিক সম্মানবোধ বজায় থাকবে। নারীদের সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন হবে। স্ত্রী নন, সঙ্গীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

এতে পরিবারটি কীভাবে উপকৃত হবে?
না. আ.:
 যে পরিবারে শোষণ নেই অর্থাৎ কমপ্লায়েন্স বা মানসম্পন্ন ফ্যামিলি, সেখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে। ফলে পরিবারটি অন্য পরিবারের তুলনায় বেশি উৎপাদনশীল হবে। অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখতে পারবে। মেধা বা যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটবে। মায়েরা অপুষ্টি থেকে রেহাই পাবে। সন্তানেরা পরিবার সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হবে। যাতে ভবিষ্যতে প্রতিটি পরিবারের সবাই সম-অধিকার ভোগ করতে পারবে। পরিবারটি হয়ে উঠবে সবার শান্তির জায়গা।

সুত্রঃ প্রথম আলো

Facebook Comments