রেহনুমা বিনত আনিস
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ ও রয়েছে, ‘Courage is not the absence of fear, but rather the assessment that something is more important than fear’.
ভয় বা সাহসের অভাব মানুষের জন্মগত দুর্বলতা। কারণ মানুষ দূরদর্শী নয়। অথচ দূরের বস্তুর প্রতি তার আকাঙ্খা অনিবার। না পাওয়ার আশঙ্কা তাকে বিচলিত করে। হারাবার সম্ভাবনা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। পেয়েও হারাবার ভীতি তাকে তাকে ত্রস্ত করে তোলে।
কিন্তু কোন বস্তুকে মানুষ যখন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুবান্ধব কিংবা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে; এই লক্ষ্যবস্তু অর্জনকে নিজের দায়িত্ব মনে করে; এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় – তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ এই দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে পারে।
জীবনের একমাত্র সত্য পরিবর্তন। পরিবর্তন থেমে গেলেই বাসা বাঁধে জড়া ব্যাধি অসত্য। তাই আমাদের সদাসর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন আমাদের চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থা কাঙ্খিত মানে আছে কি’না। যদি তা না থাকে তবে তাকে কাঙ্খিত মানে পৌঁছনোর দায়িত্ব আমাদের, সে হোক নারী বা পুরুষ।
আমাদের আদি পিতা-মাতা জান্নাতের নিরাপদ আবাস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আকুলভাবে তাঁদের প্রভূর কাছে আবেদন করেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব’ (সুরা আরাফঃ আয়াত ২৩)। এর মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কৃতকর্মের দায়ভার গ্রহণ করে নেন – অস্বীকার করেননি তাঁরা ভুল করেছেন, অভিযোগ করেননি এই ভার অন্য কারো, অনুরোধ করেননি তাঁদের পরীক্ষা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হোক। বরং এই পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময় অবস্থানকালে নিজেদের কৃতকর্মের সংশোধনে আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখে তাঁরা স্বীয় হৃত মর্যাদা পুণরুদ্ধারের কঠোর সঙ্কল্প গ্রহণ করেন।
তাঁদের না ছিলো শাপদসঙ্কুল নির্জন বিরান প্রান্তরে অবস্থান করার অভিজ্ঞতা, না ছিলো এই প্রতিকুল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার পরিপক্কতা, আর না ছিলো চিরশত্রু ইবলিসের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করার বিজ্ঞতা। সহজেই তাঁরা ভুল করলেন। হারালেন দুই সন্তানকে – একজনকে মৃত্যুর কাছে, আরেকজনকে ইবলিসের কাছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ প্রদর্শনের দায়িত্ববোধ থেকে তাঁরা গড়ে তুললেন বাকী সন্তানদের, তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে রেখে গেলেন নাবী শিশ (আ)কে।
এই একই দায়িত্ববোধ থেকে ফির’আউনের সকল অত্যাচারের সামনে অবিচল ছিলেন আসিয়া (আ)। সৃষ্টিগতভাবে একজন অবলা নারী হওয়া, বানী ইসরাঈল বংশোদ্ভুত হিসেবে তাঁর সামাজিক অবস্থানগত দুর্বলতা, ফির’আউনের পরিবারে বিবাহক্রমে শত্রুপরিবেষ্টিত পরিমন্ডল – বুদ্ধি এবং ধৈর্য্যের সাথে এই সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি মূসা (আ)কে গড়ে তোলেন সন্তানতূল্য স্নেহমায়ামমতায় যেন এই যুবক একদিন তাঁর সম্প্রদায়কে পথ দেখাতে পারে, যে অজ্ঞতার আবর্তে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে। কোন বাঁধাই তাঁকে তাঁর সঙ্কল্প থেকে টলাতে পারেনি। কারণ তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে ভালোবাসতেন, তাদের দুরবস্থার জন্য করুণা বোধ করতেন, তাদের অবস্থানের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। সাহস দিয়ে যে বিঘ্ন অতিক্রম করা যায়না, দায়িত্ববোধ দিয়ে তা থেকে উত্তরণ করা যায়। তিনি এই পথে শাহীদ হয়ে যান কিন্তু তাঁর গড়ে তোলা নাবী মূসা (আ) তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন।
মারইয়াম (আ)কে যখন বলা হোল, ‘হে মারইয়াম!, আল্লাহ তোমাকে পছন্দ করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। আর তোমাকে বিশ্ব নারী সমাজের উর্ধ্বে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম! তোমার পালনকর্তার উপাসনা কর এবং রুকুকারীদের সাথে সেজদা ও রুকু কর (সুরা আলে ইমরানঃ আয়াত ৪২-৪৩) – বুদ্ধিমতি এবং নিষ্ঠাবতী মারইয়াম (আ) বুঝতে পারেন এই মর্যাদার বিনিময়ে তাঁকে কোন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে। পরবর্তীতে যখন তাঁকে নির্দেশ দেয়া হোল এই দায়িত্ব এমন এক নাবীকে সন্তান হিসেবে ধারণ এবং প্রতিপালন করার যার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকুই আলৌকিক – তিনি ভড়কে যান। একদিকে মূর্খতার আবর্তে নিমজ্জিত সমাজে একক মাতৃত্ব নিয়ে সামাজিক কলঙ্কের ভয়, তার ওপর কিভাবে একাকী সন্তান ধারণ এবং প্রতিপালন করবেন সেই শঙ্কা। কিন্তু নির্দেশ প্রাপ্তির পর তিনি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কেবল দায়িত্বের কথাটিই মাথায় রাখেন, সকল সম্ভাব্য সমস্যা তিনি ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করেন এবং আমাদের উপহার দেন ঈসা (আ) এর মত একজন অসাধারন নাবী যার মত কেউ আগেও আসেনি, আসবেও না আর কোনদিন।
রাসূল (সা)কে নবুয়তের দায়িত্বপালনে সহযোগিতা করার জন্য আল্লাহ খাদিজা (রা)র মত একজন সহধর্মীনি মিলিয়ে দেন যিনি রাসূল (সা)কে নবুয়তপ্রাপ্তির আগে থেকেই তাঁর প্রভূর কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়ার জন্য পরিবারের অভিভাবকত্বের স্বাভাবিক দায়িত্বগুলো থেকে অব্যাহতি দেন, এবং নবুয়তের পরে যখন তিনি নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকেই বিরোধিতার সম্মুখীন হতে থাকেন তখন সাহস দিয়ে সাহচর্য দিয়ে তাঁর কন্টকাকীর্ণ পথকে যথাসম্ভব ছায়াময় করে তোলার প্রয়াস নেন। তাঁর জীবদ্দশায় একসময় মক্কাবাসীদের প্রিয়পাত্র রাসূল (সা) পথেঘাটে লাঞ্ছিত হোন, খাদিজা (রা)র পূর্বতন বিবাহপ্রসূত সন্তান হারিস রাসূল (সা)কে রক্ষা করতে গিয়ে শাহীদ হয়ে যান, মুসলিমরা দীর্ঘ তিন বছর শিয়াবে আবুতালিবে বন্দী অবস্থায় কাটান। সে সময়ও খাদিজা (রা) বিনাবাক্যব্যায়ে পাশে থেকেছেন। শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সামর্থ্যের মাঝে সর্বপ্রকার যোগান দিয়ে গিয়েছেন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি জানতেন একটি পথকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হয়। একটি দালান গড়ে তুলতে গেলে কিছু ইট মাটির নীচে চিরকালের মত কবর দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এই দায়িত্ব যারা নিয়ে নেন তাঁরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার সুযোগ থাকেনা। সেজন্যই রাসূল (সা) খাদিজা (রা)র মৃত্যুর দশ বছর পরেও দিনে একশ বার তাঁকে স্মরণ করতেন, ‘আল্লাহ তাঁর চেয়ে উত্তম নারী আমাকে দান করেননি। মানুষ যখন আমাকে মানতে অস্বীকার করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে তার সম্পদে আমাকে অংশীদার করেছে। আল্লাহ তার সন্তান আমাকে দান করেছেন এবং অন্যদের সন্তান থেকে বঞ্চিত করেছেন’।
এই আদর্শের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন মহিলা সাহাবীরা। তাঁরা জ্ঞানার্জন ও বিতরণ, সাহিত্য, রাজনীতি, চিকিৎসা, ব্যাবসাবাণিজ্য, চাষাবাদ, যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো জ্ঞানের আহরণ, চর্চা এবং প্রচারে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
কিন্তু এই সচেতনতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমান যুগের নারীসমাজ অবচেতনেও এমন এক সমাজের হাতে বন্দী যা তাকে এক শরীরসর্বস্ব প্রানী হিসেবে প্রতিভাত করতে চায়। অধিকাংশ নারীর এই আবর্ত থেকে সরে আসার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে কারণ আমরা সেই জ্ঞানের চর্চা থেকে সরে এসেছি যা আমাদের নিজেদের মর্যাদা এবং অবস্থানের ভিত তৈরী করে দেয়। আর যে অল্পসংখ্যক নারী আন্তরিকভাবে জ্ঞানার্জনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাঁদের মাঝেও জ্ঞানার্জনের সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি দেখা যায়। জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য কেবল এক টুকরো কাগজ অর্জন করা নয়, শুধুমাত্র জীবনোপকরণ উপার্জনের জন্য জ্ঞানার্জনে জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এই পদ্ধতি জ্ঞানার্জনকে বড় সংকীর্ণ, অপরিপূর্ণ করে ফেলে। জ্ঞান তো সেই উপাদান যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে, অন্ধকারকে বিদূরিত করে, মানুষের চিন্তার সীমারেখাকে প্রসারিত করে এবং মানুষকে কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়। শুধুমাত্র এজন্যই জ্ঞানের পথে চলা উচিত! বাকী সবটুকুই উপজাত (byproduct)।
আমাদের নারীসমাজ প্রায়ই নিজেদের অবহেলিত অবস্থা এবং নারীদের অবমাননার জন্য শত শত বছর যাবত ইসলামবিচ্যূত পুরুষসমাজের দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হওয়াকে দায়ী করে থাকেন। আমার প্রশ্ন, এই পুরুষরা তো নারীদের হাতেই গড়ে উঠেছে। সুতরাং এই প্রজাতির পুরুষদের জন্ম তাদের মায়েদের ব্যার্থতার সাক্ষ্য বহন করে।
চলবে….