কিঞ্চিৎ ভুল বোঝাবুঝিতে সুখের ঘরে ঢুকে পড়ছে দুখের আগুন। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। পরকীয়ার ঘটনায় একের পর এক তছনছ হচ্ছে সাজানো সংসার। ঘটছে খুনোখুনির ঘটনাও। বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহের জেরে বিবাহবিচ্ছেদ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত করছে নিষ্পাপ শিশুসন্তানদের। পরবর্তীতে এ শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। শিশুকাল থেকে পিতৃ-মাতৃহীনতার কারণে ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার নেশার জগতে। আক্রান্ত হচ্ছে নানা মানসিক রোগে। ঝরে পড়ছে বিদ্যাপীঠ থেকে। বহুবিধ কারণে সারা দেশে নারী নির্যাতন, তালাক ও পরকীয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
গত প্রায় ৫ বছরে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৫৪ হাজার ৪৯৫টি। পরিসংখ্যান বলছে গ্রামের চেয়ে শহরে তালাকের ঘটনা বেশি। তালাকে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে।
পরকীয়ার জেরে গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরে গিয়াসউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী খুন হন। পুলিশ জানায়, গিয়াসউদ্দিনের স্ত্রী লিনা তার প্রেমিক তানভীর ও তানভীরের বন্ধুদের দিয়ে স্বামীকে হত্যা করান। একই কারণে গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ায় ৭ বছরের ছেলে সাবিদ হোসেন ও স্ত্রী আইরিন আক্তার আরজুকে হত্যা করেন তার স্বামী। স্ত্রীর পরকীয়ার খেসারত হিসেবে ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিনকে লাশ হতে হয়েছে। তার সন্তানদের ভবিষ্যৎও নষ্ট হওয়ার পথে। অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তা বাবার পরকীয়ার জেরে মায়ের সঙ্গে সাবিদকে শুধু প্রাণই দিতে হয়নি, তার দেড় বছরের ছোট ভাই সানভীরের জীবন এখন অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মোবাইল ফোন, চ্যাটবক্স, ফেসবুক, যৌতুক, নেশার উন্মাদনা, বিপরীত লিঙ্গ থেকে যৌন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, আর্থিক দৈন্য, বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের নাটক-সিনেমার প্রভাবসহ মানসিক হীনম্মন্যতার কারণে পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে ভাঙছে সংসার। বাড়ছে নারীর ওপর নির্যাতন। পারিবারিক এ ভাঙনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল থাকে, সেখানকার সন্তানরাও মানসিক সমস্যায় ভোগে। ভবিষ্যতে ওই সন্তান জড়িয়ে পড়ে বহুবিধ অপরাধে।
সমাজবিজ্ঞানীরা এও বলছেন, নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। তাই স্বামী ও তার পরিবারের নির্যাতন তারা এখন আর মুখ বুজে সহ্য করছে না। তাই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১১ হাজার ৫৬৬টি তালাকের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৩১৬টি তালাক দেওয়া হয় নারীর পক্ষ থেকে। আর পুরুষের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ২৫০টি। এতসব ঘটনার মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও আইনি মীমাংসায় মাত্র ৩০৬টি তালাক প্রত্যাহার করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫টি অঞ্চলে একই সময়ে ১০ হাজার ৬৪৯টি তালাকের নোটিশ জমা পড়ে। সেখানেও তালাক প্রদানে নারীরা এগিয়ে। তালাক দেওয়ার েেত্র বেশিরভাগ নারীর বয়সই ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। আর ২০১০ সাল থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছরে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৫৪ হাজার ৪৯৫টি। পরিসংখ্যান বলছে গ্রামের চেয়ে শহরে তালাকের ঘটনা বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৯টি তালাকের ঘটনা ঘটলেও পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৮০টিতে।
বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধির ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবিব বলেন, পারিবারিক ভাঙনের একক ও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। নারীর ক্ষমতায়ন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, প্রযুক্তির বিপ্লব ও বৈশ্বিক পরিবর্তনে মানুষের রুচি বদল হচ্
ছে। আর এ কারণেই ঘর ভাঙছে। তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারে ঘর ভাঙছে পারস্পরিক অঙ্গীকার থেকে কারো সরে আসা ও রুচির পার্থক্যের কারণে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে মূল সমস্যা ভরণ-পোষণ মেটানো। তবে সব শ্রেণির পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সঙ্গ না পাওয়া, জৈবিক চাহিদা পূরণে অক্ষমতা, হীনম্মন্যতা ও অতি আবেগ বিবাহবিচ্ছেদের মূল কারণ। এ জন্য নারী-পুরুষ পরকীয়ায়ও জড়িয়ে পড়ছে।
ড. শাহ এহসান হাবিবের মতে, সংসার টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন পারিবারিক বোঝাপড়া। এছাড়াও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সহায়তায় অন্তত জেলায়-জেলায় স্থায়ীভাবে পারিবারিক কাউন্সেলিং আয়োজনের মত দেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়া অবস্থায় অনেকেই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে গোপনে বিয়ে সেরে ফেলছে। এরপর কয়েক বছর যেতে না যেতেই পরিবারের মন রক্ষা অথবা নানা দৈন্যদশায় পড়ে তারা তালাকের দিকে যাচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানান, নগর এলাকায় তালাক অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট নারী-পুরুষের স্থায়ী ঠিকানায় জনপ্রতিনিধির কাছে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু গোপনে বিয়ে করা ছেলেমেয়েরা এক্ষেত্রে তাদের ঠিকানায় চিঠি না পাঠাতে অনুরোধ করে থাকে। প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা ঘটছে।
সূত্র আরও জানায়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরায় ধনাঢ্য পরিবারে সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। বাদ পড়ছে না মডেল-তারকা পরিবারও। কিন্তু সম্মান বাঁচাতে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে তা গোপন রাখা হচ্ছে।
দিনদিন পারিবারিক বন্ধন ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে সৎ মা, পাড়া-প্রতিবেশীসহ বহুবিধ কারণে শিশুর ওপরও অত্যাচার বাড়ছে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ‘নারীর প্রতি সহায়তা সেল কর্মসূচি’ দেশের ৬টি বিভাগে গত এক বছরে সারা দেশে ৫ হাজার ২৫৪ নারী ও ৪ হাজার ৮৭৩ শিশু নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন সেল সূত্র জানায়, বিবাহবিচ্ছেদের পর আপন রক্ত-মাংসে গড়া শিশুটি যাতে নির্যাতনের শিকার না হয় সে কথা ভেবে ৬০ শতাংশ নারী চান সন্তান তাদের কাছে থাক।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহিন আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, নারীরা শিক্ষাগ্রহণ করে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হচ্ছে। এখন সে তার ভালো-মন্দ বিচার করতে জানে। আর অর্থনৈতিকভাবে সক্ষমতার কারণে নারী তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচারের জবাব দিতে শিখেছে। এছাড়া যৌতুকের দাবিসহ অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ারও ভিন্নতা আছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ায় ঘর ভাঙছে। এতে শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
লিখেছেন- হাসান জাভেদ।