‘আমারে তুমি করিবে ত্রাণ,
এ নহে মোর প্রার্থনা’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়েই নূরজাহান বেগমকে তাঁর জন্মদিনে (৪ জুন) স্মরণ করছি। কেন এই কবিতাটি বেছে নিলাম সেই ঘটনাটিও একটু বলতে চাই। ২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর। সেদিনই নূরজাহান বেগমের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ফোন করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল নূরজাহান বেগমের কণ্ঠস্বর। গবেষণার কাজে অফিসে যেতে হবে শুনেই তিনি আমাকে যা বলেছিলেন তা অনেকটা এ রকম—এত দূরে আসতে হয়তো তোমাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ তুমি প্রথম আসছ এবং তুমি একজন নারী। মনে রাখবে নতুন পথের যাত্রায় অনেক বাধা আসবে। কিন্তু যাত্রা বন্ধ করা যাবে না। তুমি যখন সেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে ফেরার পথটা তোমার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। আসার পথের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব বলেই যাওয়ার রাস্তাটা এতটা সুগম হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ কথা স্মরণ রেখো।
দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন আত্মপ্রত্যয়ী নূরজাহান বেগমের সঙ্গে এভাবেই প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাত। রবিঠাকুরের ‘আত্মত্রাণ’ কবিতার উল্লিখিত লাইন দুটো যেন এই নারীর অন্তর্নিহিত চরিত্রকেই প্রতিফলিত করছে।
২০০৫ সাল থেকে নূরজাহান বেগমকে নিয়ে আমার গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে যে সামান্য জীবন ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে, তাতে নূরজাহান বেগমের সংগ্রামী জীবনের যে ছবি পাওয়া যায় তা সত্যিই বিস্ময়কর।
নূরজাহান বেগম ছিলেন স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই বিষয়ে নূরজাহান বেগম বলেছিলেন, ‘নারী মুক্তির অর্থে আমরা কেউ কেউ অবচেতনভাবে স্বামীকে কিছুটা তোয়াক্কা না করাকেও বুঝে থাকি। কিন্তু আমার জীবনে আমার স্বামী রোকনুজ্জামান খান স্বর্গের দূত হয়েই এসেছিলেন। তাঁর সঠিক সহযোগিতা আমাকে বেগম পত্রিকায় স্থায়িত্ব প্রদান করেছে।’ তাঁর এই কথাই প্রমাণ করে তেজস্বী নূরজাহান বেগম অবচেতন বা সচেতনভাবে স্বামীকে ‘শক্র’ ভাবার মতো মনোভাব কোনো দিন পোষণ করেননি। গবেষণা চলাকালে নূরজাহান বেগম বারবার বলেছেন, ‘একজন উদার পিতা এবং আদর্শ স্বামী—এই দুই পুরুষই আমার জীবনে সফলতা এনে দিয়েছেন।’ তিনি প্রতিটি পরিবারে এমন বাবা ও স্বামীর প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। পিতা ও স্বামী যদি স্বাধীনচেতা হন, তবে নারীর আত্মনির্ভরশীলতার মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
একই সঙ্গে তিনি তাঁর মায়ের অবদানের প্রতি মাথানত করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন প্রতিক্ষণ। নূরজাহান বেগম আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার মায়ের সহযোগিতা না পেলে আমার কিংবা বাবার ধীরস্থিরভাবে কাজ করা সম্ভব হতো না। ছোটবেলা থেকে সাহস এবং উদ্দীপনার ভিত রচনাকারী আমার মা আমাকে সর্বদা মাথা উঁচু করে চলার পরামর্শ দিয়েছেন এবং দুস্থ নারীদের সাহায্য করতে বলেছেন।’
আমি নূরজাহান বেগমকে ‘আপা’ সম্বোধন করতাম। ছিলাম তাঁর নিয়মিত অতিথি। আপা গল্প করতে খুব ভালোবাসতেন। পরিচিত এবং আপনজনদের তিনি কখনো না খাইয়ে ছাড়তেন না। আপার আতিথেয়তা ছিল সর্বজনবিদিত। আলাপচারিতায় তিনি জেনে নিয়েছিলেন আমার প্রিয় খাবারের কথা। যখনই তিনি শুনতেন আমি তাঁর বাসায় যাচ্ছি, হাজির হয়েই দেখতাম কত খাবারের আয়োজন। হরেক রকমের মিষ্টি সাজানো থাকত আমার জন্য। খাবার সামনে রেখে কাজ করলেই তিনি শুধু বকা দিয়ে বলতেন, কিরে তুই খাচ্ছিস না কেন? না খেলে শক্তি পাবি কোথায়? শক্তি না পেলে এগিয়ে যাবি কীভাবে? আমি আপার অন্তরের এত কাছাকাছি চলে এসেছিলাম যে উনি আমাকে ‘তুই’ সম্বোধনে সিক্ত করলেন। আপার বাসায় ১১টা বিড়াল ছিল। মজার বিষয় ওদের প্রত্যেকের আলাদা নামও ছিল। যদিও আপার ডাক্তার হাঁপানির কারণে বিড়ালগুলোকে সরাতে বলেছিলেন। কিন্তু আপা তাঁর মায়ার টানে সেগুলোকে দূরে সরাতে পারেননি।
একদিন হলো কি, টিপু নামে এক বিড়ালকে আপা যত্ন করে খাওয়াচ্ছিলেন, তখন আমি সেই ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হতেই তিনি বিড়ালটিকে বললেন, দেখ টিপু আমার সঙ্গে তোরও ছবি তোলা হচ্ছে। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা গল্পে মশগুল হয়ে থাকতাম। গল্পের বিষয় আমাদের লেখার জগৎ, সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জগতের বিভিন্ন খবরাখবর। আপার বড় মেয়ে ফ্লোরা, ছোট মেয়ে মিতিসহ অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হতো।
২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল আপার বাসায় গেলে ফিরে আসার সময় বলেছিলেন ‘আবার কবে আসবি বল?’ তাঁর এ কথা শুনেই বলি, ‘কেন খাবার তৈরি করে রাখবেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আহা। কী রাজভোগ যেন তোকে খাওয়াই? তুই আসবি এটাই আমার আনন্দ।’ তখন আমি তাঁর নিঃসঙ্গতার কষ্ট টের পাই। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় আমি ভাবিনি এটাই আপার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
আপাকে কোনো দিন ক্লান্ত হতে দেখিনি। অফিসে তিনি যতক্ষণ থাকতেন ততক্ষণ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতেন। বাসায়ও তিনি প্রচুর ব্যস্ত থাকতেন। অফিসে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক দিলরুবা খান। অফিসে দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন আহম্মদ আলী। আমি যতবার অফিসে গিয়েছি ততবারই আহম্মদ আলী আপার কাজের ধরন সম্পর্কে আমাকে বলেছেন, আপা এত যত্নশীল তাঁর কাজে যে কোনো কিছুই ভোলেন না। সবাইকে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং সবাইকে খুব ভালোবাসেন। এ জন্য সুদীর্ঘকাল ধরে কাজ করার পরও তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেননি আহম্মদ আলী।
২০০৯ সাল। এক রাতে হঠাৎ আপা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাঁপানির কারণে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। দ্রুত আপাকে মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আমার বাসা হাসপাতালের কাছে থাকায় আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। রুমে ঢুকে আপার হাতে হাত রাখতেই উনি চোখ খুলে তাঁর ছোট মেয়ে মিতিকে বলেছিলেন, ‘এই মেয়েটা আমাকে নিয়ে গবেষণা করার সময় অনেক কষ্ট করছে। হয়তো আমার জীবনে এইটাই শেষ কোনো কাজ।’ আমার তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘তুই আমার অনেক ছবি তুলেছিস। সব সিডি করে আমাকে দিবি।’
কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারিনি আমি। ছোট মেয়ে মিতি খুব কাঁদছিলেন। হঠাৎ ছোট মেয়েকে ডেকে বললেন ছবি তোলার জন্য। ক্যামেরা রেডি করার পর দেখি উনি শোয়া থেকে উঠে বসেছেন, হাতে স্যালাইন লাগানো। আমি তাকে শুতে বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি মৃদু হেসে ভারী গলায় বলেছিলেন, ‘এখনো তো শুয়ে পড়িনি। যখন শুয়ে পড়ব তখন আর উঠব না।’ কতটা দৃঢ় ও শক্ত মনোবল থাকলে একজন মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এমন আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নিজের উপলব্ধি ব্যক্ত করতে পারেন! আমি সত্যি এতে বিস্মিত হই।
২০১৬ সালের ২৩ মে আপা অসুস্থতার কারণে ৯১ বছর বয়সে মারা যান। ৩৮ নম্বর শরৎ গুপ্ত রোডের আপার বাড়িটিরও এখন ধীরে ধীরে বয়স বাড়ছে। সময় চলছে তার নিজস্ব গতিতে। রাত কেটে আবারও সকাল হয়। আপা নেই, আছে লয়াল স্ট্রিটের বেগম অফিস। সেখানে জমে আছে কত লাখো মেয়ের স্বপ্ন।