banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 722 বার পঠিত

 

নিরালাপুঞ্জী।


ফাতিমা খান


শহর থেকে দূরে পাহাড়ের উপর ছিমছাম ছোট্ট একটা গ্রাম বলা যায়। যদিও এখানকার সরল মানুষগুলোর ধারণা তারা কোন গ্রামেও থাকে না আর শহর থেকে অনেক দূরেও তাদের আবাস না, এর থেকেও প্রত্যান্ত অঞ্চলে মানুষজন আছে এবং থাকছে। তারা আছে তো বেশ! আমার ‘সোয়ামী’ ডাক্তার সাহেব গিয়েছিলেন সরকারী সফরে আর আমি গিয়েছিলাম ওদের দেখতে।

গ্রামটার একদম শেষ মাথায় ঘন জংগল। আকাশ ছুঁইছুঁই করা বেশ কিছু গাছ, কিছু নিরপরাধ গুল্ম আর কিছু নামহীন ফুলের ঝোপঝাড়, এগুলোই জংগলের শোভা। সবুজ ঘাস আর ফার্ণ জাতীয় উদ্ভিদগুলো জংগলের ঘনত্ব বাড়িয়েছে দিগুণ। কম প্রস্থের মেঠো পথগুলোর দুপাশে বিশাল বিশাল খাদ। কিনারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আমার গা শিয়রে উঠেছিল। খাদের শেষ আমি দেখতে পাইনি। অথচ কেবল হাটতে শেখা গ্যাদা বাচ্চাগুলো দিব্যি কিনার দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমি যখন খাদের তলানি খুঁজতে ব্যস্ত তখন ৪/৫ বছরের এক খোকা খাদের গা ঘেঁষে বেড়ে উঠা এক সুঠাম গাছের দুর্বল বাহুতে দিব্যি দোলা খেতে খেতে আমাকে একটা ভেংচি কাটল। এই বাচ্চাগুলো বড় হলে ওদের ঝুলিতে জমে থাকবে অনেক দূরন্ত, দুঃসাহসী স্মৃতি। আমি ওদের সামনে সত্যি এক আনাড়ি !

দুইপাশে সারি সারি মাটির ঘর। এদের বাসিন্দাদের বেশীরভাগই পান শ্রমিক, নয়ত পান ব্যবসায়ী ।ওরা থাকে এসব মাটির ঘরে। অনেকেই খাসিয়া দলের না, জীবিকার সন্ধানে এখান ওখান থেকে আসা মানুষ।

ওদের দলনেতাকে ওরা মন্ত্রী বলে। মন্ত্রী আর তার পরিবারের সদস্যদের বাড়িগুলো শুধু আধুনিক মানের, পাকা বিল্ডিং পরিপাটি।

পুরাটাই জংগল এলাকা বলে সাপের ভয়ও আছে এখানে। বর্ষাকালে সাপের আনাগোনা বেশী, শীতকালে যে একদম নাই, এমনটাও না। শেয়াল, বনবিড়াল, হাতি, সজারু, বানর, অন্যান্য বন্য প্রানীগুলোর সাথে এখানকার মানুষ ভালই ভাব জমিয়ে রেখেছে।

নিরালাপুঞ্জীর মানুষগুলো মূলত খাসিয়া উপজাতির। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার বর্ডার এর থেকে শুধু ২ কিলো মিটার দক্ষিণপূর্ব দিকে পাহাড় আর সবুজ দিয়ে ঘেরা এই নিরালাপুঞ্জী। এখানকার মানুষগুলোর নিজস্ব ভাষা, পোষাক আর সংস্কৃতি আছে। কোন এক সময় তাদের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন দিনকে দিন তারা উন্নতি করে চলেছে, এর পেছনের একমাত্র রহস্য তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম। দলনেতা বা মন্ত্রীর সাথে কথা বলে জানলাম, তার ছেলেমেয়েরা প্রতিবেশী দেশ ভারতে লেখাপড়া করছে।

চলতে চলতে আমার সাথে এসেছিল ওই মাটির বাড়িগুলোর কোন একটা বাড়ির বউ। সে খাসিয়া নয়, বাড়ি কুমিল্লা। শ্বশুর শাশুড়ি বাবা মা সবাইকে নিয়েই সে এক কক্ষের মাটির ঘরটায় থাকে। বয়স পচিশ হবে, চোখ জোড়া কোটরে ঢুকানো, হাসতে গেলে চোয়ালের হাড় খানিকটা নড়ে চড়ে উঠে, অবয়বে বোঝা যায় অপুষ্টে বেড়ে উঠা শরীর।

এই ফ্যাকাশে হাসিখুশী মেয়েটাকেই জিজ্ঞেস করলাম,

“আচ্ছা, তোমাদের এখানে সাপ আসে না? “

“আসে, তয় কিছু করে না। লাডি নিয়া দৌড়াইলে উলটা ওরাই ভয় পায়। আপনি যান ম্যাডাম। সাপ আপনারে ধরব না। ”
এই অভয়বাণীতে সান্তণা পেলাম বটে, কিন্তু ভয় দূর হল না একটুও। সাপ তো সাপই, সে আবার কিছু না করে কেমনে? বুঝলাম তারা নিতান্ত প্রাকৃতিক জীবনযাপন করছে।

প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এই মানুষগুলো প্রকৃতির অতিচেনা আপনজন। সময় বা পরিস্থিতি বিশেষ কখনও লাঠি তুলে নেয়া প্রয়োজন হলেও কারণ বিনা তারা একান্ত পড়শী। দিনশেষে সন্ধ্যা নামছিল, এখানেও আলোর পর আধার আসে, রাতের পরে দিন। মনে হয়েছিল মাটির দেশে সবুজের আবেশে মাটির ঘরগুলোতে চাইনিজ পুতুলের মত মাটির মানুষগুলোই বসবাস করে।

Facebook Comments