banner

শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 2363 বার পঠিত

নারী- সামাজিক মনস্তত্ব

2454

 ‘নারী বা পুরুষ হয়ে কেউ জন্মায় না : সামাজিক পরিবেশ, প্রথা, সংস্কৃতি একটি শিশুকে ধীরে ধীরে নারী বা পুরুষ করে তোলে।’ সামাজিক মনস্তত্ত্ব হচ্ছে জনমনে প্রতিদিন উদিত তাৎক্ষণিক ধ্যানধারণা, মতামত, আবেগ ও খেয়াল যার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয় সমাজে জনগণের অবস্থান এবং যা তাদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে চালিত করেশ্রেণিবিভক্ত শোষণমূলক প্রতিটি সমাজে প্রতিটি শ্রেণি, গোষ্ঠী বা স্তরের একটি নির্দিষ্ট অবস্থান ও নির্দিষ্ট অবস্থান ও নির্দিষ্ট স্বার্থ থাকে, পাশাপাশি থাকে ধ্যানধারণা, মতামত ও ভাবাবেগ। এগুলোই তার সামাজিক মনস্তত্ত্ব। পুঁজিবাদী সমাজে মালিক আর শ্রমজীবীর মনস্তত্ত্ব এক নয়, এক নয় পুরুষ ও নারীর মনস্তত্ত্ব। সভ্যতার শুরু থেকেই নারী এক অবহেলিত প্রাণী হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এ কারণেই অনেকে বলে থাকেন পৃথিবী যখন অসভ্য ছিল নারীর তখন সুখ ছিল, ক্ষমতা ছিল, পরিচয় ছিল। সে-ই ছিল পরিবার ও সমাজের মধ্যমণি।

যখন থেকে সভ্যতার শুরু হলো, নারী তখন থেকেই ধীরে ধীরে নিক্ষিপ্ত হলো পরিবার ও সমাজের অাঁস্তাকুড়ে। পুরুষ প্রধান এ সমাজে কন্যাশিশুর জন্ম প্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত। কন্যাশিশুর এ অবস্থার পেছনে কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মনস্তত্ত্ব। পরিবার ও সমাজে এমন একটা বোধ গড়ে উঠেছে যে_

১. কন্যাশিশুরা পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী নয়;

২. প্রধান অর্থ উপার্জনকারী নয় বলেই তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি বিষয়ে ব্যয় করা অযৌক্তিক;

৩. কন্যাশিশু মানেই বোঝা, কারণ তার বিয়ের সময় বিপুল ব্যয়;

৪. ভবিষ্যতে ছেলেশিশুরাই পিতামাতার ভরণ-পোষণ করে;

৫. কন্যাশিশুদের মেধা কম।

আজ যে কন্যাশিশু আগামীকাল তাকেই নানা সামাজিক প্রথার ও দৃষ্টিভঙ্গির বন্ধনে জড়িয়ে নারী হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রথা ও দৃষ্টিভঙ্গি আবহমান কাল থেকে আমাদের সমাজ ধারণ করে আসছে, লালন-পালন করে আসছে। সমাজের এসব প্রথা কন্যাশিশুকে শুধু অবদমিতই করে না, তাকে পারিবারিক, মানসিক এবং শারীরিকভাবেও দুর্বল করে তোলে। যুগ যুগ ধরে এর খেসারত দিতে হচ্ছে নারীকেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু। ধর্ম মানুষের অন্তরের বিশ্বাস। এখানে যুক্তি অর্থহীন। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের প্রাথমিক পর্যায়েই নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। সম্পত্তিতে অধিকার না থাকার ফলে নারী এখনো পরজীবী হিসেবে সমাজে পরিচিত। শুধু তা-ই নয়_ এখনো অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা বস্তু বা পণ্য হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং তার স্বত্বা, মেধা বা মননকে নয় বরং দৈহিক রূপকেই বড় করে দেখা হয়। শরৎচন্দ্র তার ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন_ ‘কি পরিমাণে তিনি সেবা পায় না, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মোনা। অর্থাৎ তাহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী’ অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তি কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।

সিমঁ দ্য ব্যুভুয়া তার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’-তে দেখিয়েছেন_ ‘বুর্জোয়ারা সেই পুরনো নীতিবোধকেই অাঁকড়ে ধরে থাকে যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি পারিবারিক সংবদ্ধতার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে নারীর তেমন কোনো অধিকার নেই।’ আমাদের দেশের সব আইন পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী, কিন্তু সম্পত্তিতে অধিকারের আইনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় ধর্মীয় প্রথা। এ দেশের সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয় বিয়েই হচ্ছে সম্পদহীন কন্যাসন্তানের চূড়ান্ত গন্তব্য। ধর্মীয় বিধানও তাই বলে। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারীর শুধু ঠিকানাই বদলায় না, তার পরিচয়ও বদলে যায়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে নামটা পর্যন্ত। আর এই বদলের মধ্যদিয়েই আমৃত্যু নারীকে বরণ করতে হয় পরিচয় সঙ্কট। পাশাপাশি পুরুষকে কিছুই বদলাতে হয় না। সম্পত্তির উত্তরাধিকার যেহেতু প্রজন্মের পর প্রজন্ম পুরুষ সন্তানের মাধ্যমে নিশ্চিত করার দরকার হয় সে কারণে কন্যাসন্তানের জন্মকে সামাজিক মনস্তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে স্বাগত জানাতে পারে না। আমাদের দেশের পরিবারগুলোয় এ অবস্থা অনেকটা মনোসামাজিক বিকারের পর্যায়ে অবস্থান করছে। অন্যদিকে আজকের যুগে এসেও নারীর মুখ কালো হয়ে যায় তখন তারা জানতে পারে তার গর্ভে বেড়ে উঠছে কন্যাশিশুসন্তান। কারণ এখনো ঘরের পুরুষটিকে তারা সুখী করতে চায়, ঘরের পুরুষের কালো মুখ দেখতে তারা ভয় পায়। আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে থাকা নারীর মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে। পুরুষের অত্যাচারে, নারী-পুুরুষের সব কাজে ‘হ্যাঁ’ বলতে শিখেছিল কোনো বিবেচনা ছাড়াই। সে বুঝেছিল পুরুষের সব কাজে ‘হ্যাঁ’ না বললে এ সমাজে বা পরিবারে তার অস্তিত্ব থাকবে না। হাজার বছর ধরে চর্চিত এই ব্যবস্থার ফলে নারীর মনোবিকাশ ভোঁতা হয়ে পড়েছে।

কোনো আত্মবিশ্লেষণ ছাড়াই নারী বিশ্বাস করে পুরুষের তুলনায় তার যোগ্যতার অভাব, বুদ্ধির ঘাটতি, কর্মদক্ষতার অভাব রয়েছে। এর ফলে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ থেকেই মনে হয় পরিবারে পুরুষ হলো বুর্জোয়া আর নারী হচ্ছে সর্বহারা। নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক আসলে অধীনতার সম্পর্ক। সৃষ্টির ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখে যে নারী তার সার্বিক পরিস্থিতি, তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া খুবই ভয়াবহ। এই চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় কেবল নারীর মনোবিকাশ নয়, পুরো সভ্যতার বিকাশই থমকে যেতে বাধ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু নারী-পুরুষের সৃষ্টিশীলতায় যে সভ্যতা আজ গড়ে উঠেছে তাকে অর্থবহ করতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। এই প্রয়াসকে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমেই লিঙ্গ বৈষম্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে সব শিশুর সমবিকাশের অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। এ কাজ কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন গতানুগতিকতার বাইরে এসে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি ঢেলে সাজানো, প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রচলিত সংস্কৃতির বাইরে সমঅধিকারের চর্চায় বাধ্য করানো। সর্বোপরি সমাজ ও পরিবারের মনোজগতের পরিবর্তনের জন্য দেশব্যাপী একটি ব্যাপক ধারাবাহিক কর্মসূচি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

লিখেছেন- সুতপা বেদজ্ঞ

Facebook Comments