নারীরা বসে নেই,এগিয়ে যাচ্ছে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গনে। মুসলিম নারীরা সচেতন হয়ে উঠছে তাদের হক বা অধিকার সম্পর্কে যা আল্লাহ স্বয়ং তাদের দিয়েছেন। তারা বুঝতে শিখছে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (স:) প্রবর্তিত এ হক কেড়ে নেবার অধিকার কারও নেই; নারীরাও আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত, ঠিক যেমনি পুরুষেরা।
আমি ‘শিখেছে’, ‘উঠেছে’- এ ক্রিয়াগুলো ব্যবহার না করে ‘শিখছে’, ‘উঠছে’ ক্রিয়াগুলো ব্যবহার করেছি। কারণ আমার মতে এখনো এ প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি কোনো একস্থানে আমরা অবস্থান করছি। পূর্ণতা অর্জন এখনও বেশ দূর। মুসলিম নারী জাগরণের, নারীর অবস্থান পরিবর্তনের এ জোয়ার পুরুষদের গায়েও লেগেছে। নারীদের প্রতি তাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গীর বেশ একটা পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা এ অবস্থাকে বলতে পারি একটা Transition Period।
এ অবস্থানে অধিকাংশ পুরুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় একটি দ্বৈত চরিত্র। একদিকে নারী জাগরণের এ সময় তারা তাদের সঙ্গীনীকে কল্পনা করেন বিদুষী, শিক্ষিত, কর্মচঞ্চল, ও সচেতন এক নারী রূপে। অন্যদিকে তাদের মনের কোঠরে বাস করে তাদের শৈশবে দেখে আসা সেসব নারী চরিত্র যারা স্বামী সেবাকেই জীবনের একমাত্র কাজ ও লক্ষ্য মনে করতেন; স্বামী বা স্বামীপক্ষের সব অন্যায়, অত্যাচার, গঞ্জনা মুখবুজে সয়ে যেতেন, মুখে ‘রা’ টি করতেন না। তাদের মনে রয়ে গেছে সেই ‘বুক ফাটেতো মুখ ফোটেনা’ – গোছের নিরীহ বধূটি। অর্থাৎ তারা এর একাংশ আর ওর অপরাংশ মিলিয়ে অদ্ভুত এক কল্পিত নারী চরিত্র তৈরী করেন যা স্বভাবগতভাবেই পরস্পর বিপরীত। যে নারী সচেতন, যে নারী বহির্জগতের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস রাখেন, সে নারী নিজ স্বামীর অবহেলা-অসম্মানকে চিহ্নিত করতে অসমর্থ হবেন, বা বুঝতে পেরেও সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে গুটিশুটি মেরে যাবেন এমনটা আশা করা যুক্তিহীন।
অনেককে দেখেছি বিয়ে করার সময় বুদ্ধিমতী, চৌকষ, যোগ্য মেয়ে খোঁজেন। কিন্তু বিয়ের পরে সেই বুদ্ধিমতী মেয়েটি যখন তাকে কোনো ব্যাপারে পরামর্শ দেয় তখন অন্যদের সম্মুখে সেই পরামর্শকে মেনে নেয়াকে কাপুরুষতা মনে করেন। ভাবেন –
স্ত্রীর কথা শুনলে অন্যরা কি মনে করবে ?
সবাই বলবে আমি স্ত্রীর কথায় উঠি-বসি।
ওরা বলবে আমি একটা স্ত্রৈণ।
অথচ এটা তো খুব স্বাভাবিক যে, যেকোনো শিক্ষিত বুদ্ধিমতী মেয়েই আশা করবে যে, তার স্বামী তার সঙ্গে পরামর্শ করবে, তার মতামতের গুরুত্ব দেবে। একদিকে বুদ্ধিমতী স্ত্রী চাওয়া অন্যদিকে স্ত্রীর মতামতকে (তা যতটা মানসম্মতই হোকনা কেন) মেনে নিলে মান যাবে এমনটা ভাবা পরস্পর বিরোধী মানসিকতারই লক্ষণ।
আমার ধারণা এই Transition Period এ অনেক পুরুষই আসলে কি চাইছেন এ ব্যাপারে নিজেরাই যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না বা একধরনের দোটানায় ভোগেন। একদিকে তারা আমাদের দেশের নারীদের অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাইছেন, তাদেরকে সচেতন নারী রূপে দেখতে চাইছেন, আবার একই সাথে বাস্তব জীবনে নিজের ঘরের নারীটিকে নিজ অধিকার সম্পর্কে নীরব, নিশ্চুপ, বোধহীন দেখতে ভালবাসছেন। এ দ্বৈততার ফল খুব একটা সুখকর হয়না।
নারী স্বভাবতই ধৈর্যশীল। তবে ধৈর্য্য- সহিষ্ণুতা আর উপর্যুপরী অন্যায়-অবহেলা- অসম্মান চুপচাপ মেনা মেনে নেয়া এক কথা নয়। নারীর যেমন স্বামীর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী, তেমনি স্ত্রীর সন্তুষ্টির প্রতিও স্বামীর লক্ষ্য রাখা জরুরী। স্ত্রীর অধিকার সচেতনতাকে ‘বিদ্রোহ’ হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘স্ত্রীর আনুগত্য’ নয়, বরং স্বামী- স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতিই আমাদের পারিবারিক জীবনকে সফল করে তুলতে পারে।
লিখেছেন- কানিজ ফাতিমা নিপু। ক্যালগরি,কানাডা।