`নারী’ কেবলমাত্র একটি সত্তার নাম নয় বরং সে একটি চাহিদা শক্তি যাকে ছাড়া পুরো পৃথিবী স্তব্ধ- স্থবির। মহান আল্লাহ নারীকে প্রকৃতির অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সভ্যতা বিনির্মানে যুগে যুগে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অবদান রেখে এসেছে সমানাংশে। সভ্যতার ইতিহাস আমাদেরকে বলে, কোনো সভ্যতার উর্ধ্বগতি বা অধোগতি নির্ভর করে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়ের উপরে। মহান আল্লাহ নারীকে প্রকৃতির অপরিহার্য অংগ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
১। বিভিন্ন ধর্ম ও প্রাচীন সভ্যতায় নারীর মূল্যায়ন
প্রাচীন সভ্যতা এবং ধর্মগুলো নারীদের ব্যাপারে বিরুপ মনোভাব দেখিয়েছে। সেই সমাজে নারী স্বাধীন ছিলো না। নারী ছিলো পুরুষের দাসী। নারীর মৌলিক মানবিক অধিকার হরণ করাই ছিলো সেই সমাজের বৈশিষ্ট্য।
ইহুদী ধর্ম নারীকে পুরুষের প্রতারক বলে অভিহিত করেছে। তাদের সমাজে নারীদেরকে চাকরানীর মতো মনে করা হতো।
খ্রীষ্ট ধর্ম নারীদের ব্যাপারে নিকৃষ্টতম অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাইবেল বলছে: প্রথম পাপের সমস্ত দোষ মাতা হাওয়ার। আর যেহেতু নারী আদি পাপের উৎস , মানুষের জন্মগত পাপের কারণ , তাই সব র্ভৎসনা অবস্থা ও ঘৃণার পাত্র সেই।
প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মৃত্যু , নরক, বিষ , সর্প এবং আগুন এর কোনটিই নারী অপেক্ষা খারাপ নয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে নারী হচ্ছে সকল অসৎ প্রলোভনের ফাঁদ।
বিভিন্ন সভ্যতায় নারীর মূল্যায়নের চিত্রগুলো খুবই নীচ, হীন এব লজ্জাকর।
গ্রীসের জাতীয় উন্নয়নের প্রাক্কালে নারীর অবস্থা ছিলো শোচনীয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে রোম নগরীতে নর সমাজ তাদের Council of the wise সভায় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, Women has no soul নারীর কোন আত্মা নেই। ৫৮৭ সালে ফ্রান্সে এক সভার সভাদষগণ মহিলাদের মর্যাদা নিরুপনের সময় এভাবে তাদের মত প্রকাশ করেন whether a women could truly be considered a human being or not.
নারীদের মর্যাদা চরমভাবে ভুলন্ঠিত হয়েছে সভ্যতার দাবীদার ইংল্যান্ডে। ৮ম হেনরী মেয়েদের বাইবেল পড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মধ্যযুগের ক্যাথলিক চার্চের গুরুগণ মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতো। ১৯৬৪ সালের আগে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে মেয়েদের সমান অধিকার ছিলোনা। ১৮৫০ সালের পূর্ব পর্যন্ত মহিলারা ইংল্যান্ডের নাগরিক হিসেবে গণ্য হতোনা। ১৮৮২ সালের আগে ইংলিশ মহিলাদের ব্যক্তিগত অধিকার বলে কিছু ছিলো না।
২. পাশ্চাত্য সমাজে নারীদের মূল্যায়ন
পাশ্চাত্য সমাজে নারী ছিলো গৃহকোণে আবদ্ধ এবং পুরুষের সেবাদাসী। সব রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে সম্পূর্ণরুপে বঞ্চিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নারী স্বাধীনতার জিগির সেই সমাজ থেকেই উঠেছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারী পুরুষের যে সম্পর্ক আমরা লক্ষ্য করি তা বেশ কয়েকটি বিপ্লবের ফল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিল্পব নারীকে পুরুষের সান্নিধ্যে আসার বিরাট সুযোগ করে দেয়।
শিল্প বিপ্লবের সমসাময়িককালে সংঘটিত ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯ খৃ.) নর- নারীকে দেয় অসীম ব্যক্তি স্বাধীনতা। এই দর্শন ক্রমশ মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। ব্যক্তি স্বাধীনতার এই দর্শনকে জনপ্রিয় করে তুললো সাহিত্য জগতের যৌন- আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূচনা হয় ফ্রান্সে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসী ঔপন্যাসিক George sand এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই নারী তার উপন্যাসকে অবাধ যৌনতা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর ঘটলো আরেক বিপ্লব-মিডিয়ার বিপ্লব। আবিষ্কৃত হলো সিনেমা এবং টেলিভিশন। নগ্নতা এবং যৌনচার ক্রমশ গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চলতে লাগলো। এভাবে চিত্র দর্শন নাটক, সিনেমা , বিজ্ঞাপন, প্রভূতির অবিরাম প্রচেষ্টায় নারী পুরুষের মধ্যে সমস্ত ব্যবধান দূর হয়ে গেল। আর এ পথ ধরে সমাজে প্রবেশ করলো অসংখ্য সমস্যা।
কয়েকটি বিপ্লব ও ইউরোপের দেশগুলোর বিশ্বব্যপী রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের ফলে পাশ্চাত্য সমাজে নারী গৃহ অংশের বাইরে চলে আসে নারীরা পুরুষের সমান অধিকারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পুরুষের আরোপিত বাধা-নিষেধের সমস্ত বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে তারা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পুরোপুরি অংশ গ্রহণ করতে চায়। পুরুষদের কোনো প্রকার প্রাধান্য বিস্তার তারা চায়না। আর পুরুষরাও তাদের হাজার হাজার বছরের প্রাধান্য এক নিমিষে ধুলিস্মাত করতে রাজি হয়না। এভাবে পাশ্চাত্য সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে প্রসারিত হতে থাকে। বিগত তিনশ বছর থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছে। সর্বত্র প্রায় তার একাচ্ছত্ব রাজত্ব। পাশ্চাত্য সমাজে নারী স্বাধীনতার জিগির তোলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু নারী তার অধিকার লাভ করতে পারেনি। নারী তার পৃথক স্বাধীন সত্তা নিয়ে সমাজে নারী হিসেবে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারেনি। পুরুষের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সে আজ কক্ষচ্যুত। তার নারীত্ব আজ লুন্ঠিত দ্রব্য।
৩. মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঢেউ
প্রাচ্যের মুসলিম সমাজেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঢেউ লেগেছে। পাশ্চাত্যের শত বছরে শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাচ্যের মুসলিম সমাজের মূল্যবোধ পাল্টে দিয়েছে। মুসলিম সমাজের মেয়েরাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিজেদেরকে অসহায় ভাবছে। তারাও পাশ্চাত্যে নারীর মতো পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন কেটে বাইরে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, গত হাজার বছরে মুসলিম সমাজ ইসলামের সামাজিক বিধান থেকে অনে দূরে সরে এসেছে। যার ফলে আমাদের দেশের মুসলিম মেয়েরা সামাজিক অনিরাপত্তা নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক অবিচারের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে অমুসলিম মেয়েদের সমপর্যায়ভুক্ত দেখতে পাচ্ছে। রাসূল সা. ও সাহাবীদের যুগে মুসলিম মেয়েরা যে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করেছিলো এ অধিকারগুলো পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেই মুসলিম নারীদের অধিকারহীনতার অনুভূতির বিলুপ্তি ঘটবে। তারা তাদের পূর্ণ মানবিক অংশ ও সামাজিক মর্যাদা লাভে সক্ষম হবে। এইতো মাত্র চল্লিশ বছরের মধ্যে মুসলিম মেয়েদের একটি বিরাট অংশ প্রকাশ্য রাজপথে নেমে পড়েছে। তারা চায় তাদের অধিকার । কিন্তু ইসলাম নারীদের কি অধিকার দিয়েছে সে সম্পর্কে তারা সজাগ নয়।
৪. ইসলামে নারীর মর্যাদা
ইসলামে নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:
“তোমরা পুরুষ হও বা নারী, আমি তোমাদের কারো কাজ বিনষ্ট করবো না।” (সূরা ৩: ১৯৫)
নারীর প্রকৃতিগত অবস্থানকে সামনে রেখে ইসলাম তার দায়-দায়িত্বের পারিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। যা নারীর অবমূল্যায়ন বা পরাধীনতা নয়, বরং তার জন্যে মর্যাদা স্বরুপ। ইসলাম নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার সঠিক মূল্যায়নই নারীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। ইসলামে নারীর মর্যাদা সংক্ষেপে নিম্নরুপ:
মা হিসাবে মর্যাদা: রাসূল স. কে একজন জিঞ্জাসা করলেন আমার সর্বাপেক্ষা সদ্ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য কে? তিনি বললেন তোমার মা। লোকটি জানতে চাইলো, তারপর কে ? রাসূল সা: বললেন তোমার মা। লোকটি জানতে চাইলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জানত চাইলো তারপর কে? তিনি বললেন তোমার পিতা। (সহীহ বুখারী)
এভাবে ইসলামের পিতার চেয়ে মাতাকে সম্মান- মর্যাদার দিক দিয়ে তিনগুন বেশি মর্যাদার অধিকারী করেছেন।
কন্যা শিশুর মর্যাদা: যে কন্যা সন্তানের ভাগ্যে জীবন্ত প্রোথিত হওয়া অনিবার্য ছিল তার সর্ম্পকে ইসলামের ঘোষণা –
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত ,রাসূল সা. বলেছেন- “যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তানকে কিংবা অনুরূপ তিনটি বোনকে লালন-পালন করেছে, শিষ্ঠাচার শিক্ষা দিয়েছে, স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত এদের সাথে সদয় ব্যবহার করেছে, মহান আল্লাহ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
স্ত্রী হিসাবে মর্যাদা : বিবাহের পর স্ত্রীর সকল ধরণের দায়দায়িত্ব পুরুষের উপর চাপিয়ে ইসলাম স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। স্বামীর ব্যাপারে স্ত্রীর মূল্যায়নকে সর্বোচ্চ মান প্রদান করে ইসলাম মূলত: নারীকে সর্বোত্তম মর্যাদা দান করা হয়েছে। রাসূল সা. বলেছেন- তোমাদেরকে মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।
৫. নারীর মূল্যায়ন : বর্তমান অবস্থা
নারীর অবস্থান উন্নয়নে সময়ের সাথে সাথে প্রণীত হচ্ছে বিভিন্ন নীতিমালা, বিভিন্ন আইন, বিভিন্ন পদক্ষেপ। কিন্তু তবুও পরিবর্তন ঘটছেনা নারীর অবস্থার। তাই একবিংশ শতাব্দীর আলো ঝলমলে পৃথিবীতে দাঁড়িয়েও নারী আজ বড় অসহায়, বড় বিপর্যস্ত। বর্তমান সময়েও ঘটেছে নারী নির্যাতনের নানা ধরনের ঘটনা কখনোবা এর ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু সব ধরনের নির্যাতনের সোচ্চার প্রতিবাদ শোনা বা দেখা যায়না। কিছু ঘটনার প্রতিবাদ হলেও তা এক সময় আবার থেমে যায়। মিডিয়ার দৃষ্টিও চলে যায় অন্যদিকে। শেষ পর্যন্ত নির্যাতিত নারীকে একাই তার কষ্ট দিয়ে থাকতে হচ্ছে।
নারীকে কখনো একজন মা, কখনো একজন স্ত্রী, কখনো ছেলের বউ, কখনোবা বোন, কন্যা হিসাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় প্রতিনিয়তই। এই নির্যাতন শুধু পুরুষ দ্বারাই নয় নারী কর্তৃক ও হচ্ছে। নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকাংশ পরিবারগুলোতেই, অনুপস্থিত।
যৌতুক প্রথা সমাজে একটি সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দেশীয় আইন ১৯৮০ ও ২০০০ সালে এ নির্যাতন প্রতিরোধে আইন পাশ হলেও মিলছেনা প্রতিকার।
তালাক নারী নির্যাতনের রেকর্ডে যোগ করেছে আরেকটি নিমর্মতা। সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে রাগের বশে তালাক দেয়ার ঘটনা ইদানিং খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পারিবারিক ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নারীর অবদান ও কষ্টকে খাটো করে দেখা হয়। অনেক পরিবারে নারীদের নূন্যতম খরচের স্বাধীনতাও থাকেনা। চাকুরিজীবি স্ত্রী থেকে স্বামী জোর করে বেতনের টাকাটা নিয়ে নেয়া এটাও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কন্যা শিশু থেকে বৃদ্ধা বয়সী নারীরা পর্যন্ত প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতনের। বাস, ট্রেন, গৃহ কোন স্থানই আজ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন বয়সের পুরুষের দ্বারা ইভটিজিং এর শিকার নারীরা মানসিক পীড়ন থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এমনকি নিজেদের জীবনেও ইতি ঘটাতে বাধ্য হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী আজ বৈষম্যর শিকার। নারীদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সম্পত্তি থেকে। নারীদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে উপার্জনের ক্ষেত্রে।
৬. আধুনিক বিশ্বে নারী সমস্যার ভয়াবহ চিত্র :
ইংল্যান্ডে প্রতি ৪ জনে তিন জন মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বেশির ভাগ নির্যাতনকারী হয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা সহকর্মী।
ভারতে নারী ভ্রুণ হত্যা এবং নারী সন্তান হত্যার জন্য, বিগত শতকে ৫০ মিলিয়ন নারী নিখোঁজ রয়েছ্। ২০০০ সালে পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে ১০০০ নারীকে খুন বা করা হয়েছে।
বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কমপক্ষে ১২.৫ লাখ অবিবাহিত কিশোরী গর্ভধারণ করে।
সুসভ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি হাজারে ৩০৭ জন নারী সহকর্মীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সেখানে প্রতি মিনিটে একজন নারী হারায় তার সম্ভ্রম।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি ফ্রান্সে ২৪০টিরও বেশি সেক্সক্লাব রয়েছে।
নারী দিবসের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়কারী চীনও কন্যা সন্তান রফতানি করে আয় করে ১৫০ কোটি ডলার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০-১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোর আত্মহত্যার চিত্র শতকরা ৭৬ ভাগ।
অষ্ট্রিয়ায় কর্মস্থলে শতকরা ৮০ জনের মত মহিলা জীবনে একবার কিংবা একাধিকবার বিভিন্ন মাত্রার যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
৭. বাংলাদেশে নারীর অবস্থা
সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও নারীর প্রতি প্রায় সব ধরনের সহিংসতা বেড়েই চলেছে। নারী কেন্দ্রীক বিভিন্ন সমস্যার বিষবাষ্পে জর্জরিত আমাদের প্রিয় এ জন্মভূমির চারপাশ।
২০ মার্চ ২০১৬ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল নিরাপত্তার চাদরে আবৃত কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। এ ঘটনা দেশবাসীকে করে তুলেছিল ক্ষুব্ধ ও স্তব্ধ। তনু আজ একটি ইতিহাস যা সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহে তলিয়ে গেছে।
ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন সার্ভে ২০১৫ শীর্ষক জরিপে প্রকাশিত হয়েছে, দেশে বর্তমানে ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারীই নির্যাতনের শিকার এবং দেন মোহর পান মাত্র ১২ শতাংশ নারী।
বিগত কয়েক বছরে জ্যামিতিক হারে ধর্ষনের ঘটনা বাড়ছে। ২০১৫ সালের ১০৬৯ জন নারী ও শিশু ধর্ষনের মতো বর্বরোচিত সহিংসতার শিকার হয়েছে যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩৫% বেশী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের ২০১৫ সালের নারী নির্যাতনের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় :
o ধর্ষনের শিকার- ৭৪২
o ধর্ষনের পর হত্যার শিকার- ৮২
o যৌন নির্যাতনের শিকার-৫৯
o এসিড সহিংসতার শিকার- ৩৫
o অপহরণ- ৯২
o যৌতুকের কারণে হত্যা- ১৯২
o যৌতুকের কারণে নির্যাতিত- ১৭৩
o গৃহ পরিচারিকা নির্যাতন- ৩৬
o আত্মহত্যা- ২৯৮
o উত্যক্তের শিকার- ৩১৯
o শ্লীলতাহানির শিকার- ৯৩
৮. নারীর অবমূল্যায়নের নেপথ্যের কারণ :
কেন আজ নারীর এই অসহায়ত্ব, কেন হচ্ছে এই নির্যাতন, তা পরিপূর্ণভাবে নির্ণয়ের চেষ্টা করা হচ্ছেনা। তাই নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চলছে। মূলত যে কারণগুলো নারীর মূল্যায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলো নি¤œরূপ:
o মহান আল্লাহ প্রদত্ত নারীর মর্যাদা ও অধিকারের ব্যাপারে অসচেতনতা।
o সমাজে নারীর সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে ব্যর্থতা।
o নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা কাঠামো।
o অশ্লীল লেখনী, অশ্লীল মুভি ও পর্ণোগ্রাফির সহজলভ্যতা ।
o তথাকথিত নারী স্বাধীনতা ও অযৌক্তিক সমানাধিকার দাবীর মাধ্যমে নারীর কাঁধে কয়েকগুন বোঝা চাপিয়ে দেয়া।
o নিজেদের সম্মান মর্যাদার প্রতি নারীদেরই উদাসীনতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব।
o নারী নির্যাতনকারীদের প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগে উদাসীনতা।
তাই নারী মুক্তি আজ যুগের অনিবার্য দাবী। আল্লাহ প্রদত্ত নারীর মর্যাদা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা আজ বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তন। প্রয়োজন একটি সমন্বিত কর্মসূচি ও তৎপরতা, যা রোধ করতে পারবে নারী নির্যাতন। নারী নির্যাতনকারীদের প্রতিরোধে শক্তিশালী আইনের প্রয়োগের ম্যাধমে নির্যাতন রোধ করা সম্ভব।
আর সর্বোপরি নিজেদের সম্মান মর্যাদার প্রতি নারীদের দৃঢ় সচেতনতা আর বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসই তাদেরকে নিয়ে যেতে পারবে মুক্তির দ্বারপ্রান্তে।
তথ্যসূত্র:
১। আবদুল হালীম আবু শুক্কাহ: রাসূলের যুগে নারী স্বাধীনতা।
২। ড. মুস্তাফা আস সিবায়ী: ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী।
৩। নারী নির্যাতন বিষয়ক ওয়েবসাইন ও অনলাইন পত্রিকা।
লেখক: সাজেদা হোমায়রা
Facebook Comments