২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জন করাটা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য। এই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র নিজেদের প্রস্তুত করেছে এবং এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে নারী-পুরুষের অনুপাত হবে সমান সমান (৫০: ৫০): জেন্ডার সমতার জন্য প্রস্তুতি।’ জেন্ডার সমতার মধ্যে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত; যেমন সম-অধিকার, সমান মজুরি, সমান সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। এই সবকিছু অর্জনের জন্য নারী ও মেয়েদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতে হবে এবং সহিংসতার ভীতি ও বৈষম্যমুক্ত একটি পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ তাঁদের দিতে হবে। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ বা বৈষম্যের কারণেই নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে থাকে। এর বিভিন্ন রূপ রয়েছে যেমন: ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের মাধ্যমে নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার হওয়া, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া। তবে এ নির্যাতন করাটা শুধু কাছের বা ঘনিষ্টদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাইরের লোকজনের দ্বারাও নারীরা নানা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কেবল নারী হওয়ার কারণেই তাঁদের ওপর পুরুষেরা এ ধরনের নির্যাতন করেন।
বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতি তিনজন নারীর একজন (৩৩%) জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নিজেদের স্বামী বা নিকটতম পুরুষসঙ্গীর মাধ্যমে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নারী নির্যাতননিষয়ক একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, নারীরা তাদের বিবাহিত জীবনে একবার না একবার তাদের স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বামী বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর মাধ্যমে যৌন বা শারীরিক কিংবা উভয় ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন এমন নারীর হার ১৫ থেকে ৭১ শতাংশ। এসব সহিংসতা সংঘটনের হার ও মাত্রা দেশভেদে ভিন্ন হলেও ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব সর্বজনীন এবং স্বাস্থ্যসমস্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় ও সরকারকে দুর্বল করে দেয় এবং একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে।
নারীর প্রতি সহিংসতার ওপর ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ছিল না। তাই এ ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ ও নিরসনের জন্য সরকাির এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নিতে পারেনি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো নারীর প্রতি সহিংসতার ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। ২০১১ সালে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায়।
জরিপে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী তাঁদের স্বামী কর্তৃক কোনো না কোনো সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৭৭ শতাংশ নারী গত ১২ মাসে তারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হেয়ছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এসব নির্যাতিত নারীর মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ তাঁদের বর্তমান স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেন এবং ৮ দশমিক ৯ শতাংশ নির্যাতিত নারী তাঁদের প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেন।
বিডিএইচএস ১৯৯২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা দায়ী। এইচডিঅারসি ও ইউএন উইমেনের ২০১৩ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুমানিক ৭৬ শতাংশ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন। ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে ওই প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট পুরুষেরাই ছাত্রীদের এসব হয়রানি করে থাকেন। নারীর প্রতি সহিংসতাকে সমাজ এখনো মেনে নেয়। এ ব্যাপারে ন্যায়বিচার চাওয়ার ও পাওয়ার বিষয়টি নারী এবং দরিদ্র মানুষের জন্য এখনো দুরূহ, জটিল, ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। বিচারপ্রার্থী নারীরা নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন।
সংঘটিত সহিংসতার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন। কারণ, এসব ঘটনার প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণে ঘাটতি রয়েছে। তাই বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করাটা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাসমূহের জন্য কঠিন ব্যাপার।
তাই ইউএনএফপিএ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য ও সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষা সেবা আরও জোরদার করার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীেন বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। সহিংসতার ঘটনাগুলোর তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির সমস্যাটি সমাধানের জন্য এসব ঘটনার তথ্য একত্র করে অপরাধ তথ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে (সিডিএমএস) যুক্ত করা হচ্ছে। পুলিশ সেগুলো ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ করছে। নারীর প্রতি সহিংসতার নতুন তথ্য বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে সরাসরি দেখা যাবে। তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে প্রাথমিক উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ অধিকতর সেবা প্রদান এবং নারীদের জন্য আরও বন্ধুসুলভ সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণের পাশাপাশি তা ফলোআপের ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তারা বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। এসব প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে কীভাবে সহিংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করা যায়, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক ধারণা এবং সহিংসতার পর মানবিক সংকটের ব্যাপারে কীভাবে সাড়া দেওয়া যায় প্রভৃতি। ঢাকা মহানগরসহ চার জেলার মোট ৪৪টি থানায় পুলিশ কর্মকর্তাদের এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। থানাগুলোয় পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য একটি আদর্শ পরিচালন প্রক্রিয়া (SOP) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটি ব্যবহার করে তাঁরা অতি সংবেদনশীল ঘটনা এবং সহিংসতার শিকার নারীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সকল পরিস্থিতিতে দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন। ১৫টি থানায় নারীদের সহায়তার জন্য বিশেষ ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী পুলিশ কর্মকর্তারা নির্যাতিত নারীদের সেবা দিচ্ছেন এবং একটি সুরক্ষিত ও গোপনীয় পরিবেশে তাঁদের মামলা নথিভুক্ত করছেন। নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে রেফার করার জন্যও পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটার পরপরই তা মোকাবিলা করাটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে এসব অপরাধ প্রতিরোধ করাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করার ব্যাপারেও বাংলাদেশ পুলিশ সহায়তা করছে বিশেষ করে তরুণ–তরুণী ও কিশোর–কিশোরীদের জন্য।
জেন্ডার বিষয়ে প্রচলিত রীতিনীতির ব্যাপারে আলোচনা করে সেগুলো পাল্টাতে হবে এবং নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের জন্য আইনি প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনসহ উন্নয়নমূলক অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পারিবারিক নির্যাতনের সঙ্গে দারিদ্র্যের তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগ রয়েছে। তরুণ বয়সী, বিশেষ করে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে অধিকতর অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সুযোগ তৈরি হলে পারিবারিক নির্যাতন কমে আসবে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। এতে বাল্যবিবাহ দূর করার চেষ্টাতেও সাফল্য আসবে। কারণ, মেয়েদের দেরিতে বিয়ে হলে তাদের উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যায়। এভাবেও পারিবারিক আয় বাড়ে। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, নারী ও কন্যাশিশুর সুরক্ষায় আরও বিনিয়োগ করলে সহিংসতার শিকার নারীরা একটি উন্নততর ভবিষ্যতের আশা করতে পারেন।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত
নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ক্ষতি
ক্ষতির ধরন টাকা জিডিপির শতাংশ (%)
পরিবারপিছু ক্ষতি (মোট গড় মূল্য) ১১,১৮০ –
উপার্জনের গড় ক্ষতি ৮,২২৮ –
মোট ব্যক্তিগত ক্ষতি ১৯,৪০৮ –
প্রত্যক্ষ জাতীয় ব্যয় (কোটি টাকায়) ৮,১০৫ ১. ১৮
জাতীয় আয়ে লোকসান (কোটি টাকায়) ৫,৯৬৬ ০. ৮৭
মোট ক্ষতি (কোটি টাকায়) ১৪,০৭১ ২. ০৫
সূত্র: কেয়ার বাংলাদেশ ২০১৩