banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 258 বার পঠিত

 

নারীর মানসিক স্বাস্থ্যও অবহেলিত

পুরুষদের তুলনায় নারীরা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন বেশি, কিন্তু চিকিৎসা পান কম। দেশের প্রধান দুটি মানসিক হাসপাতালে নারীদের জন্য শয্যার সংখ্যাও অনেক কম। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানসিকভাবে অসুস্থ নারীর যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার পথে বাধা—লোকলজ্জা, কুসংস্কার আর পরিবারের অবহেলা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএমএইচ) সাধারণ মানসিক অসুস্থতাগুলোর লক্ষণ বুঝতে এ বছর দুটি এলাকায় এক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, নারী-পুরুষনির্বিশেষে জরিপে অংশগ্রহণকারী লোকজনের ৩৩ শতাংশ বিষণ্নতা, উদ্বেগ, শুচিবাই, সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তবে নারীদের মধ্যে এই হার বেশি। তাঁদের ৩৭ শতাংশ এমন অন্তত একটি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পুরুষদের মধ্যে এমন সমস্যা রয়েছে ২৭ শতাংশের।

প্রকোপ বেশি বিষণ্নতার

জরিপে অংশগ্রহণকারী লোকজনের ১৩ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছেন। পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক আহসানুল হাবীব অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব সাইকিয়াট্রির বরাত দিয়ে বলেন, দুনিয়াজুড়ে নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ। আর আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর ৪০ শতাংশই বিষণ্নতার কারণে ঘটে থাকে।

 আহসানুল হাবীব বলেন, মাসিকের সময়, গর্ভধারণের সময়ে, প্রসবের পর ও মেনোপজ বা মাসিক বন্ধ হওয়ার সময়ে মেয়েদের বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা না নিলে, পরে সেগুলোই মানসিক রোগ ডেকে আনে। এভাবে পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক অসুস্থতা বেশি হতে দেখা যায়।

এনআইএমএইচের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক আলম  বলেন, নারীরা সাধারণত বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হিস্টিরিয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় বেশি ভোগেন। প্রজননচক্রের প্রভাব তো আছেই। মেয়েদের থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাও বেশি হয়, যা থেকে এ ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসায় পিছিয়ে

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হাসপাতাল। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক হাসপাতালটিতে যান। তখন দুপুর ১২টা। বহির্বিভাগে ১০৫ নম্বর কক্ষের সামনে সাতজন রোগীর লাইন। নারী রোগী মাত্র একজন। ১০৩ নম্বর ঘরের সামনেও একই রকম দৃশ্য। এই ইনস্টিটিউট ও পাবনার মানসিক হাসপাতালের চিত্র বলছে, নারীদের সেবা নেওয়ার হার পুরুষের তুলনায় কম।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরুষ রোগী এসেছেন ২১ হাজারের বেশি। তুলনায় বহির্বিভাগে ১৬ হাজারেরও কম নারী চিকিৎসা করিয়েছেন। ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা ছিল নারীর দ্বিগুণ।

পাবনা মানসিক হাসপাতালে অবশ্য বহির্বিভাগে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি এসেছেন। কিন্তু রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা নারীর সংখ্যার প্রায় চার গুণ। কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে এল শয্যাসংকটের কথা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হাসপাতালে মোট শয্যা আছে ২০০টি। এর মধ্যে নারীর জন্য বরাদ্দ মাত্র ৬৯টি। এসব শয্যায় শিশুদেরও রাখা হয়। পাবনা মানসিক হাসপাতালের ৫০০ শয্যার মধ্যে নারীদের জন্য আছে মাত্র ১০০টি।

ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. ফারুক আলমের মতে, পুরুষেরা যেহেতু হাসপাতালে বেশি আসেন, তাই তাঁদের জন্য বেশি শয্যা। তবে তিনি বলেন, নীতিগতভাবে বা রোগের ধরন অনুযায়ী মেয়েদের জন্য শয্যা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দরকার। তিনি লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন।

এদিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক তন্ময় প্রকাশ মুঠোফোনে  বলেন, নারীদের মানসিক অসুস্থতা বেশি হওয়ায় তাঁরা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসেন বেশি। কিন্তু শয্যা কম থাকায় অনেকে ভর্তি হতে পারেন না।

অবহেলা, লোকলজ্জা

অধ্যাপক মো. ফারুক আলম মনে করেন, বেশির ভাগ পরিবারে মূল উপার্জনকারীরা পুরুষ। তাই পুরুষের অসুখ-বিসুখে দ্রুত   ডাক্তার দেখানো হয়। মেয়েদের অসুখের কথা পরিবার আমলে   নেয় না, বিশেষ করে  শ্বশুরবাড়িতে। তা ছাড়া কোনো নারীর মানসিক সমস্যা হলে পরিবারের সদস্যরা বদনামের ভয়ে তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিতে চান না। নারীরাও নিজেদের রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। তাঁদের মধ্যে রোগ লুকোনোর একটি প্রবণতা থাকে।

ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এনআইএমএইচের হাসপাতালে এসেছেন এক মা। মেয়ে তিন বছর ধরে বিষণ্নতায় ভুগছেন। কিন্তু চিকিৎসা শুরু হয়েছে দুই মাস আগে। মা বলেন, ‘মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে তো। এ জন্য চেষ্টা করেছি যাতে আমার পাড়াপ্রতিবেশী না জানেন।’ এখন অসুখের বাড়াবাড়ি হওয়ায় হাসপাতালে এনেছেন।

আরেক মা ঝিনাইদহ থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। এইচএসসি পাসের পরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন পার হতেই মেয়ে কথা বলা কমিয়ে  দেন। এখন একদম চুপচাপ হয়ে গেছেন, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মেয়ের এমন অবস্থা পর্যায়ে এসেছে ছয়    বছরে। মা বলেন, ‘এত দিন বাড়িতে চিকিৎসা করে ভালো   করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দিন দিন মেয়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল দেখে হাসপাতালে নিয়ে আসছি। এর জন্য অনেক টাকাও জমাতি হইছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, মানসিক রোগ হলে অনেকে সেটা বুঝতে পারেন না। মেয়েদের উচিত হবে লুকিয়ে না রেখে মানসিক সমস্যার কথা খুলে বলা। আর পরিবারকে বুঝতে হবে এটি একটি রোগ। সময়মতো এর চিকিৎসা করানো দরকার।

Facebook Comments