banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 457 বার পঠিত

 

নারীর ক্ষমতায়ন- অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ৩০বছর পূর্তি

কেমন ছিল সত্তরের দশকে বাংলাদেশের গ্রামীণ তৃণমূল নারীদের অবস্থা? পটুয়াখালীর চর মন্তাজের সালেহা বেগমের কথাই ধরি। তাঁকে সবাই সালেহা চাচি হিসেবেই জানে। ৩০ বছর আগে তিনি ছিলেন মুখের ওপর লম্বা ঘোমটা টেনে থাকা লাজুক নারী। অচেনা পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন পর্দার আড়ালে থেকে। পরবর্তী সময়ে এই সালেহা চাচিই চর মন্তাজের পরিবর্তনের অগ্রদূত হন। বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতায়নের সূত্রপাত। তবে তিনি বয়স্কদের শিক্ষার পরিবর্তে ভাবলেন শিশুদের শিক্ষার অধিকারের কথা। কিন্তু দুর্গম চরে বিদ্যালয় কোথায় যে শিশুরা শিক্ষায় আলোকিত হবে? সালেহা চাচি নিজেই সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি নয়, নয়-নয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি অবদান রেখেছেন। সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরে আদায় করে নিয়েছেন অনুমোদন ও নিবন্ধন। চর মন্তাজের শিশুদের শিক্ষার অধিকার আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।
সালেহা চাচির মতো অগণিত নারীর ক্ষমতায়ন সমাজের পিছিয়ে রাখা নারীসমাজের অগ্রগতিই শুধু সাধন করেনি, তারা অবদান রেখে চলেছে বৈষম্যহীন, কল্যাণকর ও সংবেদনশীল সমাজ গড়তে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নারীদের সক্রিয় বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। কারণ, নারীরা শুধু নিজের কথা ভাবেন না, ভাবেন পরিবার ও সমাজের সবার স্বার্থ ও অধিকারের কথা। এর প্রমাণও মেলে বিভিন্ন গবেষণায়। ইউনিয়ন পরিষদের পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অন্তর্ভুক্তি তাঁদের এলাকার পিছিয়ে পড়া সব গোষ্ঠীর স্বার্থ ও অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। তাঁদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দাবিদাওয়া প্রতিফলিত হয় পরিকল্পনা আর বাজেটে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অধিকারবঞ্চিত প্রতিবন্ধী, আদিবাসী কিংবা দলিত নারীর কার্যকর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে তাঁদের দাবিদাওয়াও পরিকল্পনা ও বাজেটে সহজেই প্রতিফলিত হতে পারে।
বাংলাদেশে অ্যাকশনএইড তার কার্যক্রমের ৩০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছে। দারিদ্র্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংস্থাটি নারীর ক্ষমতায়নকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছে। গড়ে তুলেছে সালেহা চাচির মতো অগণিত সক্রিয় সমাজ পরিবর্তনের বাহক। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সে প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পরিবর্তনের বাহকেরা নারীর প্রতি বৈষম্য, অবিচার, সহিংসতা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ন্যায়সংগত দাবি ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন কিংবা স্থানীয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে মানসম্পন্ন সেবা প্রদানে উদ্যোগী করতেও সক্রিয় তারা।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ নানা প্রক্রিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, দুর্যোগ মোকাবিলা, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকাঠামোয় কার্যকর অন্তর্ভুক্তিতে নারী নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমেও নারীর ক্ষমতায়নের ধারণা এগিয়ে নিয়েছে অ্যাকশনএইড। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ যুক্ত করেছে তার সহযোগী সংস্থা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী, নাগরিক সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমকে। তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

10450011_822230891152997_6977322731021705059_o
এ সাফল্য কারও একার অর্জন নয়। বরং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগসমূহের মিলিত প্রচেষ্টায়ই আজকের এ অর্জন। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণের কারণে প্রান্তিক নারীরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করতে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় কার্যকর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত পরিবর্তন এখনো আসেনি। ভাষা, উন্নয়ন এবং অন্যান্য প্রস্তাবে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার মৃদু প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পরিশেষে সেটা ব্যর্থ হয়। মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গেলে দেখা যায় যে প্রস্তাবিত বা প্রণীত আইনগুলো নারী উন্নয়ন বা তাঁদের ক্ষমতায়নকে উল্টো বাধাগ্রস্ত করছে। অতিসম্প্রতি বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর বয়সসীমা কমানোর যে প্রস্তাব করা হয়, তা উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা যায়। যদিও নাগরিক সমাজের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে সরকার সিদ্ধান্ত বদলায়।
প্রকৃতপক্ষে, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত কতকগুলো জরুরি বিষয় এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। যেমন নারীর পারিবারিক গণ্ডিতে তথাকথিত জেন্ডার ভূমিকার কি পরিবর্তন হয়েছে? নারীর গৃহস্থালি কাজকে কি উত্পাদনমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়? কৃষিতে নিয়োজিত নারী কি কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পান কিংবা প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা পান? ভূমি ও অন্যান্য উত্পাদনমুখী সম্পদে নারীর অধিকার কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও চলাচলে শহরে কিংবা গ্রামে নারী কি নিরাপদ? প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে নারীর বিপদাপন্নতা কি এখনো উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব পায়? প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকাঠামোয় নারীর অন্তর্ভুক্তি কি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত এবং তাঁরা কি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে এবং কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবেই। প্রশ্ন হলো, সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা সংশোধন করেই কি এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব? নাকি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা অন্যায় রীতিনীতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও
আচার-আচরণের পরিবর্তন ঘটানো জরুরি?

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আহ্বান জানাই—আসুন, ফিরে দেখি আমাদের স্বপ্নগুলোকে। সাজাই নতুন করে। জাগি এবং জাগাই সবাইকে। সমাজকে গড়ে তুলি ন্যায্যতা, যুক্তি আর জ্ঞানের ভিত্তিতে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গড়ে তুলি মানুষকে। এ দেশকে গড়ে তুলি সবার জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ করে। সলিল চৌধুরীর গানে কণ্ঠ মিলাই:

সেদিন আর কত দূরে/ যখন প্রাণের সৌরভে/ সবার গৌরবে ভরে/ রবে এই দেশ ধনধান্যে/ শিক্ষায় জ্ঞানে মান্যে
আনন্দের গানে গানে সুরে…

লিখেছেন-ফারাহ্ কবির: কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।

Facebook Comments