ডা. মিথিলা ফেরদৌস
এক, দুই তারিখ ব্যাক্তিগত কাজে ছুটি নিয়েছিলাম। তিন তারিখে অফিসে গিয়ে দেখি দরজার সামনে কয়জন মহিলা দাঁড়ায় আছে। আমি অফিস গিয়ে নাস্তা করে রুগী দেখতে বসি। কিন্তু এটেন্ডেন্ট বলল ম্যাডাম এই কয়জনকে একটু দেখে দেন। এরা কয়েকদিন হলো ঘুরতেছে। কি আর করা।
প্রথমজনকে ডাকলাম। পুরান রুগী।গাজিপুর থেকে কয়দিন এসে ঘুরে গেছে।আমি অবাক বললাম ‘কেনো অন্য ডাক্তার ছিলো তো? ‘বলে ‘না,আপনার চিকিৎসায় আমার ব্রেস্টের সমস্যাটা ভালো হইছে, তাই আপনাকেই দেখাবো বলে আসছি। ‘এরপর আর কি বলবো। মন ভাল হয় এমন শুনলে। অন্য সমস্যা শুনে চিকিৎসা দিয়ে বিদায় দিলাম। পরেরজনকে পাঠাইছে আরেকজন রুগী। সেই রুগীর যে সমস্যা ছিল, একই সমস্যা তাই সে আমার নাম ধাম দিয়ে আমার হাসপাতালে আমার কাছে পাঠাইছে। সেও দূর থেকেই আসা।পর পর এমন কয় টা রুগী দেখলাম।প্রথমেই মন ভাল হয়ে গেলো। সবাই যে আমাকে পছন্দ করে তা না। সবার মন রক্ষা করা সম্ভবও হয় না। এত রুগী থাকে। তাদের অনেক গল্প থাকে। তারা তা বলতে চায়। কিন্তু শোনার সময় থাকেনা।তাই বাইরে গিয়ে কিছু শুনায় দিয়েও যায়।সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের ব্যবহার খারাপ কমন কথা। তবে ১০% ও যদি খুশি হয় তাহলেও মন ভালো হয়ে যায়।
আমার রুগী বেশির ভাগ মহিলা। তাদের ৪০% ব্রেস্ট এর,৪০% পায়খানার রাস্তার সমস্যা। আর ২০% অন্যান্য। ব্রেস্ট নিয়ে কিছু বলেছি আজ বলবো পায়খানার রাস্তার মেয়েদের সমস্যা।
যদিও পায়খানার রাস্তার সমস্যা দেখার জন্যে আলাদা জায়গা আছে, সেখানে পরিক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেয়া হয়।তারপর ও প্রাথমিক যেসব চিকিৎসা দেয়া যায় সেই গুলা আমি দিয়ে থাকি।
তবে যেহেতু সার্জারিতে চার বছরের ট্রেনিং আছে এ সম্পর্কে আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে আমি যে স্যারের ট্রেনি ছিলাম। উনি ব্রেস্ট আর পাইলস ফিসচুলা মেয়েদের ছেড়ে দিতেন। ‘তোদের তো এইগুলা করেই খেতে হবে’ এই বলে। তাই প্রচুর ব্রেস্ট আর এনাল কেস অপারেশান করার সুযোগ হয়েছে।আর তাদের অনেক দুক্ষের কথাও জেনেছি। এই জন্যে আমি শ্রদ্ধেয় স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।
তাই এ ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই।মেয়েদের মুল যে সমস্যা, তা হলো কন্সটিপেসান। আর বেশি লজ্জার কারণে প্রাথমিক অবস্থায় তারা ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। ফলে রোগ গাড়ায় নিয়ে আসে। হাসপাতালে এসেও খোঁজে মহিলা ডাক্তার আছে কিনা? না হলে কবিরাজি।এই কবিরাজি যে কি ভয়ংকর তা আমি অনেক দেখেছি।
আমার মনে আছে, একবার এক মহিলার অপারেশান করার সময় তার পায়খানার রাস্তার মাংস খুলে খুলে আসতেছিলো।পুরা পায়খানার রাস্তায় দগদগে ঘা।পায়খানার রাস্তায় যন্ত্র কেন একটা আঙুল দিতে পারতেছিলাম না। অনেক কষ্টে তার পায়খানার রাস্তা বড় করে নতুন করে তৈরি করে দিয়ে আসতে হইছে। এই মহিলা আমার কাছে অনেকদিন পর অনেকদুর থেকে দেখা করতে এসে আমাকে টাকা দিচ্ছিলো, আমি রেগে গিয়েছিলাম ‘টাকা কেনো? ‘সে বলে ‘মা তুমি আমার মেয়ের মত আমি অনেকদুর থেকে আসছি তোমাকে বলতে আমি খুব কষ্টে ছিলাম, এখন আরাম পাইছি’। আমি বললাম ‘দোয়া করেন মা। ‘আমার এখনও মনে আছে মহিলা কাঁদতে কাঁদতে সূরা পড়ছিলো আর মাথায় গায়ে হাত দিয়ে ফু দিয়েছিলো। আমি অভিভুত,আপ্লুত। মাঝে মাঝে এইসবের জন্যে মনে হয় ডাক্তার হওয়া স্বার্থক।
জীবনে এমন অনেক সুখের স্মৃতি আছে আমার। সেইসব বলে বিরক্ত করবোনা।
পায়খানার রাস্তার সমস্যার উপসর্গ হলোঃ
শক্ত পায়খানা,
ফলে রক্তপরা,ব্যাথা, চুলকানো,বাড়তি চামড়া ঝুলে থাকা, কিছু বের হয়ে আসা ইত্যাদি। এছাড়া পায়খানার রাস্তার আসে পাশে ফোঁড়া হয়ে ফেটে যায়, অপরিচ্ছন্নতার কারনে। তারপর তারা কোন ডাক্তারে শরনাপন্ন হয় না, যার ফলে এই ফোঁড়া অনেক ভিতরে চলে যায়। একে বলে ফিস্টুলা। কখনও কখনও অনেক বড় অপারেশান লাগে এই জন্যে।
এছাড়া হিমোরয়েড বা পাইলস একটি কমন সমস্যা। এতেও যদি প্রাথমিক অবস্থায় কেউ আসে। ডায়েট, ড্রাগ দিয়ে সারানো সম্ভব।
সবচেয়ে কমন যে সমস্যা, তাহলো ফিসার বা পায়খানার রাস্তা ফেটে যাওয়া, এইটা খুব পেইনফুল। সাধারণত বাচ্চা হবার পর অনেক মেয়ের এই সমস্যা হয়।প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায়। না হলে ঘা হতে হতে একসময় পায়খানার রাস্তা ছোট হয়ে যায়। তখন অপারেশান ছাড়া এর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। আমি বেশির ভাগ রুগীর পায়খানার রাস্তা ছোট করে নিয়ে আসা দেখেছি। কারণ ইনডোরে কাজ করলে এইসব বেশি দেখা যায়।
এছাড়া পায়খানার রাস্তা বের হয়ে যাওয়া বা প্রোলাপ্স, ক্যান্সার, পলিপ(বংশগত ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রুপ নেয়), পায়খানার রাস্তা প্রস্রাবের রাস্তার সঙ্গে লেগে যাওয়া(দাই দিয়ে বাচ্চা হবার ক্ষেত্রে টানা হেচড়ায়)। অনেকে সিজারের বিপক্ষে অনেক কথা বললেও আমি বলবো আমি এ ক্ষেত্রে সিজারের পক্ষেই অবস্থান নিতে চাই।
পায়খানার রাস্তার সমস্যা মেয়েদের বেশি হয় কারণ, তাদের লজ্জার জন্যে রোগের বারোটা বাজায় তারপর ডাক্তাদের কাছে যায়। সবচেয়ে বড় কথা সচেতনতা।
ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কেনো ছেলে মেয়ে বিচার করতে হবে? এইটা,শরীরের একটা অংশ। এতে লজ্জার কিছু নাই। তবুও যদি লজ্জাই পান তাহলে বলবো দেশে এখন মোটামুটি সব জেলায় মহিলা সার্জন আছে। খোঁজ নিয়ে তাকে দেখান। তবুও রোগ নিয়ে বসে থাকবেন না বা কবিরাজি করবেন না। আরও আশার কথা দেশে খুব কম হলেও কলোরেক্টাল মহিলা সার্জন আছেন। অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেকেই আসবেন ইনশাআল্লাহ।
বেশি করে পানি খাবেন, শাক সবজি খাবেন। পায়খানা নরম রাখবেন আর পায়খানার রাস্তার কোন সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।আপনাদের সুস্থতাই আমার কাম্য।