ইতিহাসের পাতাজুড়ে নারীর মর্যাদা ও অধিকার বারবার পদদলিত হয়েছে সামাজিক শোষণ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও শ্রেণিবৈষম্যের কারণে।
তেমনি এক নির্মম ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দক্ষিণ ভারতের বর্তমান কেরালা রাজ্যের চের্থালা অঞ্চলের এক লজ্জাজনক কর প্রথার, যার নাম ছিল ”মুলাক্কারম” বাংলায় যাকে বলা যায় “স্তন কর”।
ঔপনিবেশিক আমলের পূর্বে তৎকালীন সমাজে নিম্নবর্ণের নারীদের যদি নিজেদের স্তন ঢেকে রাখতে হতো, তবে তাদের দিতে হতো কর। স্তনের আকার অনুযায়ী করের পরিমাণ নির্ধারিত হতো—যত বড় স্তন, তত বেশি কর! যারা কর দিতে পারত না, তাদের জনসমক্ষে স্তন অনাবৃত রাখা ছিল বাধ্যতামূলক।
এই অমানবিক ও অবমাননাকর প্রথা নারীর শরীরকে পণ্য ও করযোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল।
এই অপমানজনক করব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এক সাহসিনী নাঙ্গেলি। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ নিম্নবর্ণের নারী, কিন্তু সাহস ছিল হাজারো মানুষের চেয়েও বেশি।
যেদিন জমিদারের লোক কর আদায়ে তার বাড়িতে আসে, নাঙ্গেলি ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন হাতে নিজের কাটা দুই স্তন নিয়ে।
রক্তাক্ত সেই দৃশ্য দেখে জমিদারের লোকজন আতঙ্কে পালিয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সেদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নাঙ্গেলির এই আত্মত্যাগ শুধু একটি অন্যায় প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং নারীর মর্যাদা, সম্মান ও স্বাধীনতার সংজ্ঞা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে সমাজকে।
তার মৃত্যুর পরপরই মুলাক্কারম প্রথা বাতিল হয়।
কিন্তু ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে যায় একটি প্রশ্ন—
নারীর শরীর কি সমাজের সম্পদ? নাকি তার ব্যক্তিগত সম্মান?
এখন দেখি ইসলাম কী বলে?
ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর শরীর করযোগ্য বা অন্যের সম্পত্তি কিংবা প্রদর্শনযোগ্য কোনো বস্তু নয়, বরং তার সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষা করা সব মানুষের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ইসলাম নারীর মর্যাদাকে ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। কুরআনে বলা হয়েছে—
> “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের উপর চাদরের (জিলবাব) একটি অংশ নামিয়ে দেয়। এটি তাদের চেনার জন্য সহজ এবং উত্ত্যক্ত না হওয়ার জন্য উত্তম।”
(সূরা আহযাব, আয়াত ৫৯)
ইসলামে পর্দার বিধানের কারণে নারীদের অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি নারীর সুরক্ষায় এবং তাকে সম্মানিত করার এক চমৎকার মাধ্যম।
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নারীর শরীর কর আরোপের বা প্রদর্শনের বস্তু নয়, বরং তা গোপন রাখার ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সমাজের এবং নারীর নিজস্ব অধিকার।
কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য—
নাঙ্গেলির আত্মত্যাগের শতাব্দী পেরিয়ে এসেও বর্তমান সমাজে নারীদের একটি শ্রেণি শরীরকে আবারও উপস্থাপন করছে প্রদর্শনের বস্তু হিসেবে।
‘আমার শরীর আমার অধিকার’, ‘পোশাকের স্বাধীনতা’র নামে চলছে শরীর প্রদর্শনের এক প্রকার মহড়া।
কিছু নারী মনে করেন, শরীর দেখানোই স্বাধীনতা কিংবা সাহস।
অথচ প্রকৃত সাহস দেখিয়েছিলেন সেই নারী নাঙ্গেলি, যিনি নিজের স্তন কেটেছিলেন তা দেখানোর জন্য নয়, বরং ঢাকার অধিকার রক্ষায়।
আজ প্রশ্ন উঠতেই পারে—
নারীর স্বাধীনতা কি নিজেকে উন্মুক্ত করা?
নাকি নিজেকে সম্মানের সঙ্গে গুটিয়ে রাখা?
পছন্দমতো পোশাক পরা নারীর অধিকার বটে, তবে সেটি যেন আত্মমর্যাদা ও সামাজিক সংবেদনশীলতার সীমা অতিক্রম না করে।
সত্যিকারের শক্তি হলো নিজেকে সংযত রাখা, আত্মমর্যাদায় দৃঢ় থাকা-
যেমন ছিলেন নাঙ্গেলি, যেমন শিক্ষা দেয় ইসলাম।
লেখকঃ আরওয়া আনাম