banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 719 বার পঠিত

 

ধর্ষণ পরিক্রমা: ধর্ষণের ব্যধিতে আক্রান্ত স্বদেশ

নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কলম, ফেসবুক, টুইটার, আর টিভিগুলো সারাদিন কথা বলছে। ধর্ষণের ব্যধিতে ভীষণভাবে সংক্রামিত হয়েছে দেশ। ব্যক্তি ধনী হোক বা দরিদ্র, শিক্ষার হার বেশি কিংবা কম; সবখানেই ধর্ষণ একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে।

সম্প্রতি দেশজুড়ে ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মানুষের ভাবনার কেন্দ্রে চলে আসছে। নারীর প্রতি সমাজের মনোভাব, সমাজে নারীদের আরও অনিরাপদ করে তুলছে। বিশেষ করে ধর্ষণের দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া, বিচারহীনতা, ভিক্টিম ব্লেমিং, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত দায় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

নারীর প্রতি সহিংসতার বর্তমানে প্রায় লাগামহীন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১শ’ ৭ সেকেন্ডে একজন নারী ধর্ষণ অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। যা বছরেয প্রায় ২ লাখ ৯৩ হাজার নারী ধর্ষণ অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

নারীর প্রতি সহিংসতায় বাংলাদেশের চিত্র আরো ভয়াবহ। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’, ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের’ তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালে সেপ্টম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৭ হাজার ৫শ’ ২৭ টি।

এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ৩ হাজার ২শ’ ৯০ টি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে মানবাধিকার সংস্থা- আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৫ মাসে ৬শ’ ৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই সময় ১শ’ ৪২টি ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্য থেকে ২৯ জন ভুক্তভুগি আত্মহত্যা করেছে। ৫ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ধর্ষকদের বিষাক্ত দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশু, প্রতিবন্ধী থেকে ষাটোর্ধ্ব মহিলা কেউই। ২০২০ সালে গত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯শ’ ৭৫ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২শ’ ৮ জন।

এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন। আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। সংগঠনটি আরো জানায়, গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হয়েছেন।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন , ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫শ’ ১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫শ’ ৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮শ’ ৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। ১৪ টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি বলছে, গত বছরে ১ হাজার ৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এটা আগের বছরের তুলনায় কম হলেও ধর্ষণ ও নির্যাতনের ধরণ ছিলো নির্মম। ঘটনাগুলোকে ‘ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা’ এই তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮শ’ ১৮ জন নারী। ২০১৭ সালে ৯শ’ ২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৮ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭শ’ ৩২ জন। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭শ’ ২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি।

২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৩শ’ ৫৬ টি। ২০১৮ সালের চেয়ে গত বছর শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১৩ নারী। ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন।

বিশ্বজুড়ে প্রায়ই অধিকাংশ নারীই কোন না কোন ভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রায় ২০ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত চলাকালে ধর্ষণের এই পরিসংখ্যান প্রায় একই রকম।

২ বছর আগেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী কোন না কোন ভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং ৭% নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উন্নত অথবা অনুন্নত দেশ, সবখানেই একই চিত্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষণ কেন হচ্ছে? কেনই বা ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে? এই প্রশ্নের উত্তর কেবল শুধু মাদক-পর্নোগ্রাফি বা বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকে দায়ী নয় বরং পুরো দায়টি রাষ্ট্রের ওপর এসে পড়ে। ধর্ষণ মামলায় পড়ছে হাজার হাজার বছরের পর বছর ধরে শুধু আলোড়ন তৈরি সাজা হচ্ছে দুই বা চার জনের।এই সমাজ সুদীর্ঘ সময় ধরে মনস্তাত্ত্বিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বছরের পর বছরজুড়ে।

ধর্ষণ তখনই থামবে যখন ধর্ষকের সাজা হবে চরমভাবে এবং প্রতিটি ধর্ষকের বিচার হবে। কঠোর পরিণতি দেখে ভয়ে ধর্ষনকামী হয়ে উঠা অমানুষগুলো মানুষ হয়ে উঠবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ধর্ষণের যে পরিসংখ্যান আমরা দেখছি এর পিছনে লুকিয়ে আছে আরেকটি ছবি, সেই পরিসংখ্যানটি আমাদের অজানা। ধর্ষণের যে তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয় সেটি কেবল পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগ অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি। বিশাল কিন্তু একটি বিশাল সংখ্যা, লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর পরিবার যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে না।

Facebook Comments