পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ক্যারিবীয় দ্বীপ অ্যান্টিগার বাসিন্দা কিনিয়াহ ম্যাকে। ছবি : বিবিসি
ক্যারিবীয় দ্বীপ অ্যান্টিগার বাসিন্দা কিনিয়াহ ম্যাকে। বয়স মাত্রই ১১ বছর। হলে কী হবে, এই বয়সেই মেয়েটি জলবায়ু সংকট সম্পর্কে রীতিমতো সচেতন! কিনিয়াহ জানে, গাছ কমে গেলে পরিবেশে অক্সিজেন হ্রাস পায়। আরো জানে, উপকূলে আবর্জনা ফেললে সামুদ্রিক কচ্ছপরা মরে যায়, যারা কিনা সুন্দর রাখে সমুদ্রের পরিবেশ।
‘তরুণদের পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে’—বলে কিনিয়াহ। কথাটা বলার সময় এমন ভাবগম্ভীর দেখায় তাকে, কে বলবে বয়স মাত্রই ১০ পেরিয়েছে। বিবিসির সাংবাদিক যখন কিনিয়াহ ম্যাকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন মাত্রই মার্চের মাঝামাঝি। কিন্তু এরই মধ্যে সূর্য ভয়ানক রকম তাপ ছড়াচ্ছে চারদিকে।
কিনিয়াহর ক্লাসরুমের বৈদ্যুতিক পাখাগুলো বনবন করে ঘুরেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা করতে পারছে না ঘর।
ক্যারিবীয় অঞ্চলের বাকি অংশের মতো অ্যান্টিগায়ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিত্যদিনের বাস্তবতা। সৈকতের আকার হ্রাস, ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা ক্রমেই তীব্র হওয়া, তীব্র খরা আর গ্রীষ্মকালের ক্রমেই দমবন্ধ করা হয়ে ওঠা তার প্রমাণ।
তবে দ্বীপের মানুষের একাংশ এ অবস্থার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে লড়ছে।
কিনিয়াহ তাদেরই একজন। ওদের এলাকার ৬০ জনের বেশি বিভিন্ন বয়সের নারীকে উপকূল রক্ষার কর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয় কমানোর জন্য দেশীয় গাছ লাগানো, বিপন্ন কচ্ছপের বাসা বাঁধার স্থানগুলো রক্ষা এবং সৈকতের আবর্জনা রাখার ডাস্টবিন তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনার কাজ দেওয়া হয়েছে তাদের।
স্থানীয় এনজিও ‘অ্যাডপ্ট-এ-কোস্টলাইন’-এর নেওয়া এই প্রকল্পটি এতটাই সফল যে গত আগস্টে জাতিসংঘের গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) থেকে এক লাখ ডলার অনুদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ৬০০ আবেদনের মধ্যে নির্বাচিত মাত্র ২৩টি উদ্যোগের অন্যতম এটি।
এনজিওটির নির্বাহী পরিচালক ক্যাট বাইলস জানিয়েছেন, তাঁদের কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়ে নারী ও কম বয়সী মেয়েদের ‘আরো বেশি সোচ্চার হতে’ উৎসাহিত করা।
নারী-পুরুষের কাজকর্মের ক্ষেত্র নিয়ে এখনো ক্যারিবীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশে সেকেলে ভাবধারা বহাল। কিনিয়াহদের স্কুলের প্রিন্সিপাল রায়োনা শ জোসেফ তাঁর একদল শিক্ষার্থীকে নিয়ে সৈকত পরিচ্ছন্ন করার কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে খুবই আনন্দিত। ‘প্রাকৃতিক সম্পদের যত্ন নেওয়াটা শিশুদের শেখাতে হবে, যাতে তা ভবিষ্যতের জন্য টিকিয়ে রাখা যায়’, বলেন তিনি।
অ্যান্টিগার মাত্র ২৪ বছরের তরুণ এমপি কাইশা জোসেফ একদিন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আপাতত তাঁর মনোযোগ অবশ্য তরুণদের নিয়ে অ্যাডপ্ট-এ-কোস্টলাইনের পরিবেশ সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার ওপরই নিবদ্ধ।
বিবিসিকে কাইশা জোসেফ বলেন, ‘আমরা অ্যান্টিগা এবং বারবুডায় এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে কিছু ভূমিকা শুধু পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। অনেক নারীই এখনো সেই ধাত্রী, শিক্ষক এবং সেক্রেটারির মতো গতানুগতিক চাকরির পেছনেই ছোটেন।’
অ্যান্টিগার পশ্চিম উপকূলের পেনশনারস বিচ কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকদের দেখভাল করা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। কাইশা স্বেচ্ছাসেবী দলটির ফেলে দেওয়া টায়ার থেকে তৈরি করা ডাস্টবিনগুলোকে দেখালেন বিবিসির সাংবাদিককে। এ কাজে না লাগানো হলে টায়ারগুলোর ঠাঁই হতো ভাগাড়ে। ধবধবে সাদা বালির এ সৈকতের কিনার ঘেঁষেই রয়েছে সিগ্রেপ গাছের সারি। দৃশ্যটা ভিউকার্ডের ছবির মতোই নয়নাভিরাম। প্রতিবছর এই রৌদ্রোজ্জ্বল দ্বীপে আসা লাখো পর্যটককে মুগ্ধ করে এই ছবি। কিন্তু মুগ্ধ পর্যটকের ঢলের বিপরীত চিত্রটি হচ্ছে অবিরাম বর্জ্য জমে ওঠা। ভ্রমণের মৌসুমে প্রায়ই রাজধানী শহরের বন্দরে দেখা যাবে এক থেকে কয়েকটি বিশাল পর্যটকবাহী প্রমোদতরি।
আগামী মে মাসেই অ্যান্টিগায় বসছে জাতিসংঘের চতুর্থ উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সম্মেলন। তখনো বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতাসহ কয়েক হাজার দর্শনার্থীর চরণ পড়বে এখানে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সম্ভাব্য শিকার ছোট দ্বীপগুলোর টেকসই উন্নয়নের সামর্থ্য মূল্যায়ন করা এ সম্মেলনের লক্ষ্য। এমপি কাইশা জোসেফের মতো তরুণী নারীদের মতামত এখানে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
অ্যান্টিগা সরকারের যুব দপ্তরের কর্মকর্তা ক্যারোলাইন পেরি বলেছেন, এখন আগের চেয়ে বেশি নারী উচ্চতর শিক্ষা নিলেও তাঁরা এখনো উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার চাকরি পেতে বেগ পান। তাঁর মতে, মেয়েদের অল্প বয়স থেকেই ক্ষমতায়িত করা গেলে সমাজের রূপান্তর ঘটবে।
অ্যাডপ্ট-এ-কোস্টলাইন মেয়েদের দাতব্য দোকানে বিক্রির জন্য সামুদ্রিক বর্জ্য থেকে গহনা, পাখির বাক্স এবং বেঞ্চ তৈরি করা শিখিয়ে কিছু হলেও আয়ের পথ করে দিচ্ছে। অ্যান্টিগার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা জেনিফার মেরান্টো ২০০৯ সালে এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সবার আগে নিজের ‘কৃতকর্মের প্রতিকার’ করতে চান। এ জন্য নিজে গত ২০ বছরে দ্বীপের মাটিতে যে পরিমাণ আবর্জনা সৃষ্টি করেছেন তার একটা সম্ভাব্য হিসাব বের করেছেন। তিনি দেখেছেন, বর্জ্যের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে যায়। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগে নিজের ‘অবদান’ মুছে ফেলবেন।
দ্বীপের সৈকতগুলো থেকে এক হাজার ব্যাগ বর্জ্য সরানোর মাধ্যমে কাজটা শুরুও করেছেন জেনিফার মেরান্টো। সূত্র : বিবিসি।