ফাতিমা শাহীন
কবি ফররুখ আহমেদ এর কবিতার সাথে আমাদের পরিচয় শৈশব থেকেই। দেশের শিশু কিশোর পাঠ্যক্রমে আগে সেসব বিষয়ই নির্বাচিত করা হত যেসব রচনায় থাকত নিষ্পাপ কচিপ্রাণ শিশু কিশোরদের মন ও মননকে বিকশিত করার সমৃদ্ধ উপাদান। ছোট্ট বেলা থেকেই যেন মনুষ্যত্বের পূর্ণ রূপটি শিশুদের নিষ্পাপ অন্তরে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারে , শিক্ষা কার্যক্রমে থাকত সেই প্রচেষ্টা। এরই অংশ হিসেবে আমরা পড়েছি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সাহিত্য সম্ভার , কবি গোলাম মোস্তফার অসাধারণ বিনির্মানগুলো , কবি ফররুখ আহমেদের উদ্দীপনাময় কাব্যসৃষ্টি সমূহ। এভাবে পড়তে পড়তে কবে থেকেই যেন ফররুখ আহমেদের পাঞ্জেরীর সাথে আমি হয়ে গেছি একাত্ম , অভিন্ন হৃদয় :
“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী ,
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে
সেতারা , হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে ?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরি। ”
তাইতো , ফররুখ আহমেদ আমার প্রানের কবি , আত্ম জাগরণের কবি , প্রিয় কবি !
ফররুখ আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী প্রতিভার নাম। তিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি নামেই বেশি পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের যে ক’জন স্বপ্নমুগ্ধ কবি ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারার মধ্যে থেকে পাঠকের চোখে ও অন্তরে তাদের স্বপ্ন ও মুগ্ধতাকে সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে পারঙ্গম হয়েছিলেন , নি:সন্দেহে কবি ফররুখ আহমেদ তাঁদের মধ্যে একজন। ঘুনে ধরা , পাপ দগ্ধ এক সমাজের অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে সুবেহ সাদিকের পবিত্র আভায় উদ্ভাসিত এক ভোরের পরম আকাঙ্খী ছিলেন তিনি , যা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘ সাত সাগরের মাঝি ‘ কবিতার বহু ছত্রে :
” কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানিনা তা’
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা
দুয়ারে তোমার সাত সাগরে জোয়ার এনেছে ফেনা ,
তবু জাগলেনা ? তবু তুমি জাগলেনা ? ”
যে সুন্দরতম আদর্শকে আশ্রয় করে মানবতা হয়ে ওঠে মহীয়ান , গরীয়ান … তাকে তিনি বাঙ্ময় কাব্যজ্যোতির প্রদীপ্ততায় উদ্ভাসিত করে ফুঁটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘ সিরাজুম মুনীরা ‘ কবিতা নিজস্ব মহিমায় :
” কে আসে , কে আসে সাড়া পড়ে যায়
কে আসে , কে আসে নতুন সাড়া !
জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ , জাগে শতাব্দী ঘুমের পাড়া।
হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আনো প্রিয় আবহায়াত ,
জানি সিরাজাম-মুনীর তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত ,
তব বিদ্যুত্কনা – স্ফুলিঙ্গে লুকানো রয়েছে লক্ষ দিন
তোমার আলোয় জাগে সিদ্দিক , জিন্নুরাইন , আলী নবীন। ”
তাঁর অসাধারণ রচনাসমূহের মধ্যে একটি তাত্পর্যপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে দিগন্ত ছোঁয়া নীল সমুদ্র , উত্তাল উর্মীমালার বিক্ষুব্ধ সন্তরণ। এর মাধ্যমে তিনি কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুঁটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সৃষ্টি লগ্ন থেকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারে নিরন্তন সংগ্রাম ও আন্দোলনকেই :
” এ ঘুমে তোমার মাঝি মাল্লার ধৈর্য্য নেইকো আর
সাত সমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার ,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধ’রে
বেসাতী তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে ? ”
আজ এ যুগে , এ ক্ষয়রোগে ধরা মুমূর্ষ সমাজে , যেখানে পাপ পঙ্কিলতা ও অশুভ আচার নির্বিবাদে বাড়িয়ে চলেছে তাদের অশুভ কালো বাহু , যেখানে অনৈতিকতার বিষবাষ্প সমাজকে পতনের শেষ সীমায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে , সেখানে আজ ফররুখ আহমেদের মত ভোরের নকীবদের আজ বড় প্রয়োজন! যিনি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের অশান্ত তরঙ্গমালা সামাল দিয়ে সাত সাগরের মাঝিদেরকে হেরার রাজ তোরণের দিক নির্দেশনা দিতে পারেন , পাঞ্জেরীকে দিতে পারেন ধ্রুব তারার খোঁজ , এমন কবি ও লেখকদেরকেই এ সমাজে আজ বড় বেশি দরকার।
আর তাই , কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে খ্যাতিমান কবি জাহানারা আরজু লিখেছিলেন ,
” এক মঞ্জিল , এক নিশানা হেরার রাজতোরণ
জীবন বোররাখ ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বে গতিময়
তৌহিদের বাণী বয়ে , বুকে যার অসীম বিস্ময় ,
কলমের পুষ্পিত পরাগে জাগে অনন্য ভুবন ! ”
প্রানপ্রিয় এ কবির জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এর দরবারে মাগফিরাত কামনা করি।