banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 716 বার পঠিত

 

দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে

দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে


ফাতিমা মারিয়াম


এক
-আসসালামু আলাইকুম
-ওয়া আলাইকুম আসসালাম…কেমন আছ?
-আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি…আপনি কেমন আছেন?
-আমিও ভালো…এতদিনেও তুমি আমাকে আপনি করে বলছ? এখন যদি অভ্যাস না কর তবে পরেও তো পারবে না!
-যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে। নাস্তা খেয়েছেন?
-হুঁ খেয়েছি…তুমি খেয়েছ?
-জি…আজ সকালে নামাজ পড়েছেন?
-পড়েছি…তবে সময়ের পরে।
-কেন? আজও উঠতে পারেন নি?
-না, তুমি এক কাজ করতো… প্রতিদিন ভোরে নামাজের টাইমে আমাকে জাগিয়ে দেবে।
-তারচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি আপনার মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখেন।
– তা হয় কিন্তু আমি চাই তুমিই আমাকে ডেকে দেবে। তোমার কথা শুনেই দিনটা শুরু করতে চাই। তাহলে দিনটা ভালো যাবে।
-এটা কুসংস্কার তা জানেন?
-জানি…কিন্তু আগামীকাল থেকে নামাজের সময় তুমিই আমার ঘুম ভাঙাবে।
-আচ্ছা এখন রাখি। আম্মু ডাকছে…
-আচ্ছা রাখছি…মনে থাকে যেন।

দুই
জেবা মায়ের রুমে এসে দেখে তার মা আলমারি খুলে একগাদা কাপড়চোপড় নামিয়ে নিয়েছেন। এগুলো এখন মা মেয়ে দুজনে মিলে গোছাবে। কাপড় ভাঁজ করতে করতে আসমা জেবাকে জিজ্ঞাসা করে- জাহিদ আজ রাতে আসিফকে আসতে বলেছে।

-কেন?

– এমনিই…অনেকদিন ছেলেটা আসে না। জাহিদ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে আর রূপাকে বলে গেল রাতের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতে।

-আমার সাথে তো কিছুক্ষণ আগেই আসিফের কথা হল! আমাকে তো এই বিষয়ে কিছুই বলল না!

– হয়ত মনে ছিল না।

মা মেয়ে দুজনেই কাপড় গুছানো শেষ করে বসে বসে গল্প করছে। এমন সময় জেবার ভাবী রূপা শাশুড়ির রুমে আসল। – মা আজ দুপুরে আর তেমন কিছু করছি না।কালকের যা আছে তা দিয়েই আমাদের চলবে। রাতের জন্য এখন থেকেই কিছু কাজ গুছিয়ে রাখি।

-রূপা, তাহলে তুমি যতটুকু পার করতে থাক আমি জাওয়াদকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। এসে সবাই মিলে বাকী কাজ শেষ করে ফেলব। জেবা তুইও রূপাকে হেল্প কর।

– তোমার আদরের বৌমার কোন কষ্ট হবে না আম্মু। আমি তার পাশেই থাকব। চিন্তা কোর না।

আসমা নাতিকে স্কুল থেকে আনতে বের হয়ে গেলেন।

মা বেরিয়ে যেতেই জেবা বলল-ভাবী আসিফকে আজ দাওয়াত দেয়ার কি দরকার ছিল? আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।

-অস্বস্তির কি আছে? তুই তো আর ওর সামনে যাবি না। বিয়ের এখনো দুই/তিন মাস বাকী। মাঝেমধ্যে তো ও আসবেই। এটাই স্বাভাবিক।

-ওর সাথে প্রতিদিন কথা বলতেও আমার ভালো লাগে না।

-তোর ভাইয়াই তো তোকে বলেছে ওর সাথে মাঝেমধ্যে কথা বলতে। এখানে তোর খারাপ লাগার কি আছে? এত খুঁতখুঁতে হলে এই যুগে চলা যায় না। আমি নিজেও এইভাবে কথা বলা পছন্দ করি না। কিন্তু আসিফ তোর সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য, তোকে কিছুটা বোঝার জন্য রিয়াদ ভাইকে বলে তোর ভাইয়াকে রাজি করিয়েছে। মা আর আমি আপত্তি করায় তোর ভাইয়া বলল বর্তমানে এসব বিষয় কোন ব্যাপার না। তাই আমরাও আর কিছু বলিনি। এখন তো মাও আসিফ কে বেশ পছন্দ করেন। এসব কথা রাখ তো এখন আয় আমরা মা আসার আগেই কিছু কাজ গুছিয়ে ফেলি।

তিন
রূপাকে কিছু কাজ গুছিয়ে দিয়ে রূপা নিজের রুমে চলে আসলো। আসলে ভাবীর কাছে স্বীকার না করলেও সে প্রতিদিন আসিফের ফোনের অপেক্ষায় থাকে।আগে ওর মোবাইল ছিল না। এঙ্গেজমেন্ট এর পরে ভাইয়া ওকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। যাতে করে সে তার রুমে থেকেই আসিফের সাথে কথা বলতে পারে। ল্যান্ডফোনের সেট মায়ের রুমে। তাই জেবার সুবিধার জন্যই ভাইয়া এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

প্রথম প্রথম একটু কেমন জানি লাগলেও আসিফের সাথে গল্প করতে এখন তার কাছেও বেশ ভালো লাগে। ভাইয়ার বন্ধু রিয়াদ ভাই এই বিয়ের ঘটক। আসিফ উনার প্রতিবেশী। ভালো ছেলে, ভালো চাকুরী করে, পরিবার বেশ ভালো সব কিছু মনের মত হওয়াতে জাহিদ মা সহ সবার সাথে আলোচনা করেই পাকা কথা দেয়। এখন শুধুমাত্র এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে। বিয়ে হবে আসিফের বোন এবং দুলাভাই দেশে আসার পর। উনারা প্রবাসী। তিন চার বছর পরপর দেশে আসেন। এবার তারা যে সময়ে আসবে সেই সময়ে বিয়ে হবে।

বিয়ের ডেট এখনো ঠিক হয় নি। আসিফের বোন আসার পরপরই ডেট হবে। তারপর বিয়ে। দুই পরিবারেই বিয়ে উপলক্ষে প্রস্তুতি চলছে। আসিফ প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে। তেমন দরকারি কোন কথা না। কথায় কথায় তাদের সময় বেশ ভালোই কাটে। হুট করেই আসিফ ফোন করে বলবে- আগামীকাল আমার রুমের জন্য ম্যাচিং করে পর্দা আর বিছানার চাদর কিনব। তোমার কি রঙ পছন্দ বল তো! একসেট কিনব তোমার পছন্দ মত আরেক সেট কিনব আমার পছন্দ মত। অথবা আবার কোনদিন বলবে- তুমি কি জামদানী শাড়ি পছন্দ কর? আমি আজ খুব সুন্দর একটা জামদানী কিনে এনেছি। কি কালার সেটা বলব না।তবে এটুকু বলতে পারি তোমার পছন্দ না হয়েই যাবেনা। এভাবে সে আরো কিছু শাড়ি থ্রি পিস কিনে রেখেছে। যখনই যা কিনবে তাই জেবাকে জানাবে। এসব শুনতে জেবার খারাপ লাগে না।

চার
প্রায় দেড় মাস পরের কথা।

আসিফের বোন মিনু ও দুলাভাই মইন বাচ্চাদের নিয়ে দেশে এসেছেন। এসেই তারা জেবাকে দেখতে এসেছেন। মিনু যতক্ষণ এই বাসায় ছিল জেবা, রূপা ও আসমার সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। এমনিতেও মিনু বেশ হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। পরিচিত অপরিচিত সবার সাথেই গল্প করতে বেশ পছন্দ করে। তার স্বভাবসুলভ হাসি আনন্দ দিয়ে সে জেবার পরিবারের সবার সাথে কথা বলে গেছে।

কিন্তু বাসায় গিয়ে সে যা বলল তা শুনে আসিফ এবং তার বাবা মা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে জেবাকে তার পছন্দ হয়নি। জেবার গায়ের রং পুরোপুরি ফর্সা নয় আর হাইটও কম।

আসিফ আমতা আমতা করে বলল- আপু তুমি এসব কি বলছ? সব কিছু ঠিকঠাক। দুই পরিবারে প্রস্তুতিও নেয়া হয়ে গেছে। এখন কিভাবে ওদের না বলা যায়?

-আচ্ছা আমি তোকে একটি মেয়ে দেখাচ্ছি। যদি এই মেয়ে তোর পছন্দ না হয় তবে জেবাকেই আমরা বউ করে আনব। এই মেয়েটাকে আমি কয়েকদিন আগে দেখেছি। যদি আগে দেখতাম তবে জেবার সাথে তোর এঙ্গেজমেন্ট করার প্রশ্নই আসত না। তোর দুলাভাইয়ের এক বন্ধুর মামা তার স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ে নিয়ে কিছুদিন আগে আমাদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমাদের বাসাতেই উঠেছিল। তখন উনার মেয়ে উর্মিকে দেখে আমাদের খুব পছন্দ হয়। দেখতে যেমন সুন্দর আলাপ ব্যবহারও তেমন ভালো। আমি মেয়ের মা বাবাকে হালকা ভাবে কিছু বলে রেখেছি।তারা আমাকে বলেছে আমরা দেশে এসে যেন তোকে নিয়ে তাদের বাসায় যাই। মা আর তোকে নিয়ে আগামীকাল আমি ওখানে যাব। তারপর ওকে দেখে সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

 পরদিন আসিফ মিনু আর মায়ের সাথে পাত্রী দেখতে গেল। মেয়ে দেখে আসিফ ও তার মা মুগ্ধ! এত সুন্দর মেয়ে! বাসায় এসে সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলো উর্মিকেই বাড়ির বউ করে আনবে।

কথার ফাঁকে আসিফ একবার মিনুকে বলল – কিন্তু আপু জেবা বা জেবার পরিবার আমাদের কি মনে করবে? এতদিন ধরে………

-আরে থাম তো! এঙ্গেজমেন্ট মানেই কি বিয়ে না কী? এখনো আমরা বিয়ের ডেটই ঠিক করিনি। এখন তো মানা করে দিতেই পারব। আর তুই এখন জেবার সাথে কোন কথা বলবি না। ও ফোন করলেও রিসিভ করবি না।

পাঁচ
সেদিন মিনু এসে দেখা করে যাবার পর থেকে আসিফের বাসার কেউই ফোন করছে না। জেবার বাসার সবাই ভাবল ওরা হয়ত ব্যস্ত! সামনে অনুষ্ঠান আর তাছাড়াও মিনু এবং তার বর তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এতদিন পরে এসেছে। ওদেরকে নিয়েও তো সবাই ব্যস্ত। তিন চার দিন চলে গেল।

আরো দুইদিন পরে জেবা আসিফের নাম্বারে কল দিল। আসিফ এই কদিন একবারও জেবার সাথে কথা বলে নি। জেবা বেশ চিন্তিত। যত ব্যস্তই থাকুক জেবার সাথে আসিফ কথা না বলে থাকতেই পারে না। রিং হচ্ছে না, মোবাইল বন্ধ। জেবা কিছুক্ষণ পর আবার কল দিল। এখনো মোবাইল বন্ধ।

সন্ধ্যার পরও আসিফকে পেল না। আসিফের কোন সমস্যা হয়েছে কি না জেবা বুঝতে পারছে না। তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে রূপাকে বিষয়টা জানালো। রূপা গিয়ে শাশুড়িকে বলল মা আসিফের বাসায় একটু ফোন করে দেখুন তো ওদের কি হয়েছে? আসিফের মোবাইল বন্ধ কেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি না একটু জানা দরকার।

আসমা আসিফের বাসার নাম্বারে কল করলেন। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে ঐ বাসার বুয়া ফোন রিসিভ করল। বুয়া আসমাকে চিনতে পারল না। ভাবল হয়ত আসিফদের কোন আত্মীয়। তাই সে আসমাকে জানালো যে মিনু দেশে এসে আসিফের জন্য অন্য মেয়ে দেখিয়েছে। সেই মেয়েকে বাসার সবাই পছন্দ করেছে এবং আজ ওখানে সবাই গেছে ডেট ঠিক করার জন্য। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে।

আসমা রিসিভার নামিয়ে রেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। মানুষ এভাবে প্রতারণা করতে পারে? এইজন্যই আসিফ তার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে? আসমা বুঝতে পারছেন এখন তাকে শক্ত থাকতে হবে। তিনি যদি ভেঙ্গে পড়েন তবে জেবাকে কে সাহস যোগাবে? মেয়েটাকে আসিফের সাথে কথা বলতে, যোগাযোগ রাখতে পরিবারের সবাই উৎসাহ দিয়েছিল। সেই সুযোগে আসিফ ওর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করত। তিনি যদি এই কথা বলা সাপোর্ট না করতেন তবে আজ জেবাকে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হত না। উনি নিজেকেই দোষী মনে করছেন।

আসমা রুপা আর জাহিদকে উনার রুমে ডেকে পাঠালেন। ওরা আসলে তিনি পুরো ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে রুপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আসমা খুব শান্ত গলায় বলল- কান্না করনা রুপা। আমাদের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে। তা না হলে জেবা ঠিক থাকবে কিভাবে?

জাহিদ মনে মনে নিজেকেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করছে। মুখ ফুটে মা বা রুপার সামনে কিছু বলতে তার সাহস হচ্ছেনা।

এদিকে আসিফের বন্ধ মোবাইলে জেবা বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে… মনে মনে আশা এবার হয়ত রিং হবে, সে শুনতে পাবে আসিফের গলা!

[এই গল্পের পটভূমি বেশ আগের। তখন বাংলাদেশের মানুষ মাত্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শুরু করেছে। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। তাই আসিফ তার মোবাইলের সিম বন্ধ রেখেই জেবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল।]

Facebook Comments