দু’সন্তান হারিয়ে মনে হলো আমি এক ব্যর্থ নারী। মা হতে চেয়ে দু’ দু’বার গর্ভপাতের শিকার হয়ে আমার হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। নিজের লেখা বই ‘এক্সট্রাক্টেড ফ্রম ইয়েস্টারডে, টুডে, টুমোরো’তে এমনই লিখেছেন এক সময়কার তুমুল জনপ্রিয় ইতালিয়ান তারকা অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেন। তার লেখা বইয়ের খ-াংশ ছাপা হচ্ছে ডেইলি মেইলে।
সেখানে তিনি আরও লিখেছেন, ২৯ বছর বয়স যখন ছুঁয়েছি আমি, তখন থেকেই আমার সন্তান লাভের ইচ্ছা প্রচ- তীব্র হয়ে উঠলো। আমি শিশুদের খুব পছন্দ করতাম। ছবির সেটে, শিশুশিল্পীদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যেত। শুটিং শেষ হওয়ার অনেক পরও তাদের সঙ্গে থাকতাম আমি। ১৯৫৭ সালে ‘হাউজবোট’ চলচ্চিত্রে আমার সঙ্গে একটি ছোট্ট মেয়ে অভিনয় করেছিল। সমপ্রতি সে জানালো যে, সে দাদী হয়েছে। কিন্তু ১৯৬৩ সালে ২৯ বছর বয়সী কেউ প্রথম মা হবে, বিষয়টি বেমানান ছিল। আমি তখন দ্বিধান্বিত ছিলাম আদৌ আমি মা হতে পারবো কিনা। কাকতালীয়ভাবে ইতালির নেপলসে সাত বছর বয়সী এক শিশুর মা হিসেবে অভিনয় করতে গিয়ে আমি গর্ভধারণের লক্ষণ অনুভব করি। বেশ কয়েকদিন ধরে আমার মধ্যে এমন মা হওয়ার একটা আলাদা বোধের জন্ম নেয়। শেষ পর্যন্ত আমি ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। কিছু পরীক্ষার পর জানা গেল আসলে আমার অনুমান সত্য নয়। তবে এরপরও আমার সেই অদ্ভুত অনুভূতি রয়ে যায়।
এরপর রোম থেকে একজন ‘বিশেষজ্ঞ’ এলেন। তার হাতে একটি কালো চামড়ার ব্রিফকেস ছিল। যখন সে এটি খুললো, আমি চমকে উঠলাম! এর ভেতর একটি ছোটো সবুজ ব্যাঙ ছিল, যেটি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল! আমাকে আরও হতভম্ব করে দিয়ে ডাক্তার আমার সামান্য মূত্র নিয়ে ব্যাঙের শরীরে ঢুকিয়ে দিলো। এরপর আমাকে বললো, যদি ব্যাঙটি মারা যায়, তবে বোঝা যাবে তুমি গর্ভবতী! বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙটি নড়াচড়া করতে লাগলো অদ্ভুতভাবে। মনে হচ্ছিল যেন, এর মাথায় কেউ ঘা দিয়েছে! কিন্তু এটি মারা যায় নি! বিরক্ত হয়ে আমি চলে এলাম এবং কিছুক্ষণের জন্য হাঁটতে বের হলাম। একই সঙ্গে বেচারা ব্যাঙকে একটি পুকুরে ছেড়ে দেয়া হলো। ‘খুব খারাপ’- আমি নিজেকে নিজে বললাম। কিছুক্ষণের জন্য ভাবলাম আমি বোধ হয় গর্ভবতী। সত্যি কথা হলো, আমি আসলেই গর্ভবতী ছিলাম। যখন ব্যাপারটি নিশ্চিত হলো, আমি খুবই খুশি হলাম। এতটা খুশি আমি এর আগে কখনই হই নি। আমি আমার সন্তানের মুখ দেখার জন্য কিছুতেই অপেক্ষা করতে পারছিলাম না! কিন্তু এর পরের দিনগুলো এত সুখের সঙ্গে অতিক্রম করি নি আমি। সত্যি বলতে কি, সে দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ ও বিষণ্ন দিন। আমি শুধু এতটুকুই বলতে পারি, কিছু একটা ঠিক ছিল না। এরপর আমি আরেক ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন এবং পরামর্শ দিলেন যাতে আমি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে কোথাও না যাই। তাই আমি আমার ছবির পরবর্তী লোকেশন মিলানে গিয়েছিলাম ট্রেনে করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমার প্রথম দৃশ্য ছিল একটি গাড়িতে চড়ে বাধা বিপত্তি অতিক্রম করা। এটা সত্যিকার গাড়ি ছিল না। তবে নকল হলেও, সত্যিকার গাড়ির চেয়েও খারাপ ছিল! মিলানে প্রথম দিনই আমি মারাত্মক যন্ত্রণায় ভুগি। হোটেলের লিফটে চড়তে না চড়তেই আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ি। আমি এখনও হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা আমাকে কল্পনা করতে পারি। হাসপাতালের আলো, সাদা দেয়াল এবং অদ্ভুত এক গন্ধ আমার হৃদয়কে যেন ছেদ করে যাচ্ছিল।
সেদিন রাতে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা পেয়েছি এক নার্সের ঘৃণাপূর্ণ মুখ দেখে। তারা সবাই আমাকে দোষী মনে করছিল। বিশ্বের আর সবার মতো, তারাও জানতো যে আমি আমার পার্টনার প্রযোজক কার্লো পন্টিকে বিয়ে করি নি। কিন্তু এর কারণও ছিল। তার আগের বিবাহিত জীবন বহু আগেই ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু ইতালিতে তখনও ডিভোর্স ছিল অবৈধ। সে সব নার্সরা ভেবেছিল যে, তারা সত্যিকার গল্প জানে। কিন্তু তারা আসলে আমার সমপর্কে বা আমার ইচ্ছা ও ভয় সমপর্কে কিছুই জানে না। তারা ছিল অমানবিক ও অনুভূতি বিবর্জিত মানুষ। আমার সমপর্কে তাদের এই ভিত্তিহীন অপমান ছিল কুসংস্কার ও অজ্ঞতার ফসল। শেষ পর্যন্ত আমি সন্তান জন্ম দিতে পারি নি। তার আগেই আমার সন্তান মারা যায়। এরপর আমি সোজা কাজে চলে যাই। কিন্তু এরপর আমি অনেকটা শূন্যতা বোধ করি। আমি সামনে তাকাবার মতো কিছু খুঁজে পাই না। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কিছুই যেন ছিল না। সদ্য জন্ম নেয়া শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে প্রস্তুত হতে চলা নতুন মায়ের যে সুখ, সে তুলনায় তারকা হিসেবে আমার জীবন যেন কিছুই মনে হচ্ছিল না আমার কাছে।
চার বছর পর ‘মোর দ্যান অ্যা মিরাকল’-এর শ্যুটিং চলাকালে আমি আবার গর্ভবতী হই। এবার আমি আরও প্রস্তুত ছিলাম। প্রথম লক্ষণ দেখা যাওয়া মাত্রই আমি কার্লোকে ডাকলাম। বলে উঠলাম, আমি গর্ভবতী! কিন্তু এবার আমি আরও সতর্ক থাকবো। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। আমি নিজেকে বাধ্য করলাম বিছানায় শুয়ে থাকতে। আমি কিছুই করি নি। আমি কিছু পড়ি নি, টিভি দেখি নি। আমি এমনকি যতটা সম্ভব খুব আস্তে কথা বলছিলাম এবং আমার পেট সপর্শ করাটাও এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। যদি আবার এতে আমার সন্তানের কোন ক্ষতি হয়! কিন্তু মনের ভেতর কে যেন বলছিল যে, একই জিনিস বোধ হয় আবার ঘটবে। যন্ত্রণার প্রথম লক্ষণ ভালোই ছিল, এখনও আমি খুব ভালো করে মনে করতে পারি। আমাদের রোমান পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত সুন্দর প্রাসাদে আমার পাশে ছিল প্রিয় বন্ধু বাসিলো। কার্লো তখন লন্ডনে ছিল কাজে। বাসিলো ডাক্তার ডেকে এনেছিল। ডাক্তারকে সে বলছিল, তাড়াতাড়ি আসুন। সে কুঁচকে যাচ্ছে, ভূতের মতো সাদা হয়ে যাচ্ছে। তার বোধ হয় অসহ্য লাগছে। কিন্তু আমার মহান ও জ্ঞানী ডাক্তার অহংকারী আত্মবিশ্বাসী সুরে বললেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। তাকে কিছু ক্যামোমিল খাওয়ান। আমরা এ নিয়ে আগামীকাল কথা বলবো।
আগামী পর্ব- আমার কক্ষে তখন অন্যরকম উষ্ণতা
সূত্র- মানবজমিন।